জ্ঞানার্জন করার পর তদনুযায়ী আমল না করার ভয়াবহ পরিণতি

প্রশ্ন: ইলম জানার পর না মানলে কী সমস্যা ?

উত্তর:

কুরআন ও হাদিসে দ্বীনের জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে অনেক বেশি উৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআনের প্রথম আয়াত হল, ‘ইকরা’ “পড়ো”। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ইলম বা জ্ঞানান্বেষণকে ফরজ (অত্যাবশ্যক) বলে ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে পর্যাপ্ত আলোচনা এসেছে।
ইসলামে জ্ঞানার্জনের প্রতি এত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এ জন্য যে, যেন তারা জ্ঞানের আলোকে সত্য-মিথ্যা, হক-নাহক, হালাল-হারাম, বৈধ-অবৈধ ইত্যাদি জেনে-বুঝে আমল করে, নিজের মধ্যে থেকে জাহেলিয়াত বা মূর্খতা সূলভ আচরণ দূর করে এবং সমাজকে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাষিত করে। সুতরাং কেউ যদি জ্ঞানার্জন করার পরও তা নিজের জীবনে প্রয়োগ না করে তাহলে সে মূলত: জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যকেই ব্যহত করল। তাই নিম্নে কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফদের বক্তব্যের আলোকে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হল।

❑ জ্ঞানার্জন করার পর তদনুযায়ী আমল না করার পরিণতি:

যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো সে ফরজ লঙ্ঘন করার কারণে গুনাহগার তো হবেই কিন্তু যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করার পরও আমল থেকে দূরে থাকলো তার পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ।

নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল:

◉ ১. কিয়ামতের দিন আল্লাহ বিচারের কাঠগড়ায় কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হবে:
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الْأَسْلَمِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تَزُولُ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَ فَعَلَ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَ أَبْلَاهُ
[رواه الترمذي: 2417، وقَالَ هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ]
আবু বারযা নাদলা ইবনে উবায়েদ আসলামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“কিয়ামতের দিন বান্দাহর পদযুগল সরবে না, যে পর্যন্ত না তাকে জিজ্ঞেস করা হবেঃ তার জীবনকাল কিরূপে অতিবাহিত করেছে, তার জ্ঞান কি কাজে লাগিয়েছে, তার সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করেছে এবং কিসে খরচ করেছে এবং তার শরীর কিভাবে পুরানো করেছে?”

[ইমাম তিরমিযী এ হাদীস (নং-২৪১৭) বর্ণনা করে বলেন, হাদীস টি হাসান ও সহীহ।]

◉ ২. ইলম অনুযায়ী আমল না করলে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে হবে:

হাদিসে এসেছে:
وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ ‏.‏ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ ‏.‏ وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ ‏.‏ فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ ‏.
“তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার করা হবে-যে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করেছে এবং কুরআন অধ্যায়ন করেছে। তখন তাকে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের কথা তাকে স্বরণ করিয়ে দিবেন এবং সেও তার স্বীকার করবে।

তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ এই জ্ঞান দ্বারা তুমি কী করেছো?
জবাবে সে বলবে: আমি জ্ঞানার্জন করেছি এবং তা (অন্যকে) শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার উদ্দেশ্যে কুরআন পড়েছি।

আল্লাহ তায়ালা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি তো জ্ঞানার্জন করেছিলে এজন্যে যে, লোকেরা তোমাকে জ্ঞানী বলবে। কুরআন তিলাওয়াত করেছিলে এ জন্যে যে, লোকেরা তোমাকে কারী (কুরআন পাঠক) বলবে। আর তা তো বলা হয়েছে।

তারপর আল্লাহর আদেশ ক্রমে তাকেও উপুড় করে টেনে-হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”
[সহীহ মুসলিম (ইফাঃ) হাদিস নম্বরঃ (৪৭৭০) অধ্যায়ঃ ৩৪/ রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রশাসন]

◉ ৩. ইলম অনুযায়ী আমল না আল্লাহর ক্রোধের কারণ:

ইলম অনুযায়ী আমল না আল্লাহর ক্রোধের কারণ এবং এটি মূলত: করা ইহুদিদের চরিত্র। তাইতো আল্লাহ তাআলা সূরা ফাতিহার মধ্যে ইহুদিদেরকে الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ বা “আল্লাহর ক্রোধের শিকার” বলা হয়েছে। এর একটি অন্যতম কারণ হল, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল কৃত আসমানি কিতাব তওরাতের জ্ঞান রাখত কিন্তু তদনুযায়ী আমল করতো না। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের সন্তানের মত করে চিনতো কিন্তু তারপরও তাকে স্বীকার করে নি। (দেখুন, সূরা আনআম: ২০)

❑ জ্ঞানার্জন করার পর তদনুযায়ী আমল করার গুরুত্ব সম্পর্কে কয়েক জন মুসলিম মনিষীর বক্তব্য:

নিম্নে জ্ঞানার্জন করার পর তদনুযায়ী আমল করার গুরুত্ব সম্পর্কে কয়েক জন মুসলিম মনিষীর বক্তব্য তুলে ধরা হল:

● ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহ. (জন্ম: ১০৭-মৃত্যু: ১৮৭ হিজরি) বলেন:
على الناس أن يتعلموا فإذا علموا فعليهم العمل
“মানুষের জন্য শিক্ষার্জন করা আবশ্যক। আর যখন শিক্ষার্জন করবে তখন তা আমল করা আবশ্যক।”

● আব্বাসিয় খলিফা আব্দুল্লাহ ইবনুল মুতায (মৃত্যু: ২৪৭ হি:) বলেন:
علم بلا عمل كشجرة بلا ثمرة
“আমল ছাড়া ইলম ফলহীন বৃক্ষের মত।”

● তিনি আরও বলেন:
علم المنافق في قوله وعلم المؤمن في عمله

“মুনাফিকের জ্ঞান হল, তার কথার মধ্যে আর মুমিনের জ্ঞান হল, তার কর্মের মধ্যে।”

● আবু আব্দিল্লাহ রুযবারি (মৃত্যু: ৩৬৯ হিজরি) বলেন:
العلم موقوف على العمل والعمل موقوف على الإخلاص والإخلاص لله يورث الفهم عن الله عز وجل
ইলম (জ্ঞান) নির্ভর করে আমল (কর্ম) এর উপর। আর কর্ম নির্ভরশীল ইখলাস (একনিষ্ঠতা) এর উপর। আর ইখলাস বা একনিষ্ঠতা আল্লাহর তরফ থেকে বুঝার ক্ষমতা এনে দেয়।”

এ প্রসঙ্গে সালাফে সালেহীন ও বিজ্ঞজনদের অনেক সুন্দর সুন্দর বক্তব্য আছে।

মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞানর্জন করে তদনুযায়ী আমাদের জীবনকে ঢেলে সাজানোর তওফিক দান করেন। আমীন।
▬▬▬▬◢◯◣▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
জুবাইল, দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স, সৌদি আরব।