কোন বাক্যটি কালেমা তাইয়েবা

‘কালেমা তাইয়েবা’ কোন বাক্যটি? শুধু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নাকি ‘মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ সহ উভয়টি? আর আখিরাতে মুক্তির জন্য কি উভয়টির স্বীকৃতি দেওয়া আবশ্যক?

প্রশ্ন: ‘কালেমা তাইয়েবা’ বলতে কী বুঝায়? এর দ্বারা কি শুধু “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” উদ্দেশ্য না কি ‘মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ও এর অন্তর্ভুক্ত? আখিরাতে মুক্তির জন্য কি উভয়টির স্বীকৃতি দেওয়া আবশ্যক না কি কেবল ১মটির স্বীকৃতি যথেষ্ট?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: কালিমা তাইয়েবা বলতে কী বুঝায়-এ বিষয়ে আমাদের সমাজে যথেষ্ট ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই মনে করে তা হল, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ” পুরোটাই কালিমা তাইয়েবা। কিন্তু তা সঠিক নয়। বরং তা হল, কেবল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনও উপাস্য নেই)। এটাকে কালিমাতুত তাওহিদ (একত্ববাদের বাণী) এবং কালিমাতুল ইখলাস (একনিষ্ঠতার বাণী) বলা হয়।

তার অর্থ এই নয় যে, মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রসুল বা প্রেরিত দূত)-এর স্বীকৃতি ও সাক্ষ্যের প্রয়োজন নাই। বরং সঠিক কথা হল, তাওহিদের স্বীকৃতি হিসেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং রিসালাতের স্বীকৃতি হিসেবে মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ ছাড়া কেউ মুসলিম হতে পারবে না এবং আখিরাতে মুক্তি পাবে না।

নিম্নে এ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আলোচনা উপস্থাপন করা হল:

◈ ১. ‘কালিমা তাইয়েবা (পবিত্র বাক্য) দ্বারা উদ্দেশ্য হল, “লা ইলা হা ইল্লাল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনও উপাস্য নাই):

আল্লাহ তাআলা বলেন,

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ
“তুমি কি লক্ষ্য কর না, আল্লাহ তাআলা কেমন উপমা বর্ণনা করেছেন: কালিমা তাইয়েবা বা পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মত। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত।” [সূরা ইবরাহিম: ২৪]

ইবনে আব্বাস রা. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,

( مثلا كلمة طيبة ) شهادة أن لا إله إلا الله ، ( كشجرة طيبة ) وهو المؤمن ، ( أصلها ثابت ) يقول : لا إله إلا الله في قلب المؤمن ، ( وفرعها في السماء ) يقول : يرفع بها عمل المؤمن إلى السماء
وهكذا قال الضحاك ، وسعيد بن جبير ، وعكرمة وقتادة وغير واحد

“কালিমা তাইয়েবা (كلمة طيبة) হল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্য প্রদান করা, পবিত্র বৃক্ষ (شجرة طيبة) হল, মুমিন ব্যক্তি, যার শিকড় মজবুত (أصلها ثابت ) অর্থাৎ মুমিনের হৃদয়ে থাকে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আর তার শাখা আকাশে উত্থিত (وفرعها في السماء)। এ কথার অর্থ হল, এর মাধ্যমে মুমিনের আমল আসমানের দিকে উত্থিত হয়। এমনটি আরও বলেছেন, যাহ্হাক, সাঈদ বিন জুবাইর, ইকরিমা, কাতাদা প্রমুখ মুফাসরিরগণ। [তাফসিরে ইবনে কাসির, তাফসিরে কুরতুবি ইত্যাদি]। আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন বলেন,
أما المقصود بالكلمة الطيبة فهي كلمة الإخلاص: لا إله إلا الله
“আর কালিমা তাইয়েবা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কালিমাতুল ইখলাস-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” [binothaimeen]

◈ ২. জিকির হবে কেবল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর। (মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ-এর নয়)। কেননা হাদিসে কেবল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কে শ্রেষ্ঠ জিকির হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

أفضلُ الذِّكْرِ لا إله إلا اللهُ

“শ্রেষ্ঠ জিকির হল, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ।” [তিরমিজি, ইবনে মাজাহ-হাদিসটি সহিহ। উৎস: সহিহুল জামে, হা/১১০৪, সহিহুত তারগিব ১৫২৬]

অত:এব জিকির করার সময় কেবল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করতে হবে। (মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ নয়)। আমাদের সমাজে অনেক মানুষ উভয় বাক্যকে জিকির হিসেবে পাঠ করে থাকে। এটি বিদআতি পদ্ধতি।

◈ ৩. “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এর স্বীকৃতি কিয়ামতের দিন আল্লাহর রসুলের শাফায়ত লাভের আবশ্যকীয় শর্ত:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ ‏

“কিয়ামতের দিন আমার শাফায়ত লাভ করে সবচেয়ে বেশি ধন্য হবে সে যে একনিষ্ঠ চিত্তে পাঠ করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনও উপাস্য নাই)।

উল্লেখ্য যে, আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবী হল, তাঁর প্রেরিত দূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রসুল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। কেউ যদি তা না করে সে প্রকারান্তরে আল্লাহর উলুহিয়াতকে স্বীকৃতি দিলো না।

◈ ৪. “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এর স্বীকৃতি জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদ:

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

فَإِنَّ اللَّهَ قَدْ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ ‏.‏ يَبْتَغِي بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ ‏

“যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে ’লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে অর্থাৎ- আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ বা মাবুদ নেই বলে ঘোষণা করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন।।” [সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী), অধ্যায়: ৫। মাসজিদ ও সালাতের স্থানসমূহ, পরিচ্ছেদ: ৪৭. কোন ওজরবশত জামাতে শরিক না হওয়া]
উল্লেখ্য যে, কেউ যদি কেবল মুখেমুখে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” পাঠ করে কিন্তু বাস্তব জীবনের তার বিপরীত কাজ করে তাহলে এই সাক্ষ্য প্রদান মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হবে। এই জন্য আলেমগণ এর ৭টি শর্ত উল্লেখ করেছেন। সেগুলো আমাদের জেনে নেওয়া আবশ্যক।

◈ ৫. “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ” মূলত: পৃথক পৃথক দুটি বাক্য। যথা:
১ম বাক্য: “লা ইলাহা-ইল্লাল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনও উপাস্য নাই)।
২য় বাক্য: “মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ” (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রসূল)।

সুতরাং দুটি বাক্যকে কালিমা তাইয়েবা বা ‘একটি পবিত্র বাক্য’ বলা ভাষাগতভাবেও সঠিক নয়। তবে মুসলিম হওয়ার জন্য উভয়টির স্বীকৃতি দেওয়া আবশ্যক।

❑ আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রসুল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের আবশ্যকতা:

✪ ক. আল্লাহকে একমাত্র সত্য উপাস্য এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর প্রেরিত দূত হিসেবে স্বীকৃতি ও সাক্ষ্য দেওয়া ছাড়া ইসলামের প্রবেশ করা সম্ভব নয়:

আল্লাহকে ইলাহ (উপাস্য) হিসেবে এবং নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর রসুল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখার নির্দেশ:

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ

“আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনও উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ র বান্দা ও তার রসূল…।” [সুনান আত তিরমিজি (তাহকীককৃত), অধ্যায়: ৩৮/ ঈমান, পরিচ্ছেদ: ২. আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ বলবে এবং নামাজ আদায় করবে]
সুতরাং মুক্তি পেতে হলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’; মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ উভয়টি পাঠ করা আবশ্যক।

✪ খ. যে ব্যক্তি আল্লাহর তাওহিদের সাক্ষ্য দেওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর রসুলকে স্বীকৃতি প্রদান করবে এবং এ ক্ষেত্রে অন্তরে সামান্য পরিমাণ সন্দেহ পোষণ করবে না সে জান্নাতে প্রবেশ করবে:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,

“‏ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللَّهِ لاَ يَلْقَى اللَّهَ بِهِمَا عَبْدٌ غَيْرَ شَاكٍّ فِيهِمَا إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‏

“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই এবং আমি আল্লাহর রসুল। যে ব্যক্তি এ বিষয় দুটোর প্রতি সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস পোষণ করত আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [সহিহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ১। ঈমান, পরিচ্ছেদ: ১০. যে ব্যক্তি তাওহিদের উপর মৃত্যুবরণ করবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে-এর প্রমাণ।]

✪ গ. জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ইমান আনা আবশ্যক:

শুধু আল্লাহর প্রতি ইমান আনা যথেষ্ট নয়। বরং কেউ যদি এর পাশাপাশি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান না আনে তাহলে সে জাহান্নামে যাবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ

“সে সত্ত্বার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, আমার উম্মতের ইহুদি হোক আর খৃষ্টান হোক, যে ব্যক্তি আমার বিষয়ে শুনেছে, অথচ আমি যে রিসালাত নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছি তার উপর ঈমান আনেনি এবং এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, অবশ্যই সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ১/ কিতাবুল ঈমান, পরিচ্ছেদ: ৬৯. আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকল মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছেন এবং অন্য সকল ধর্ম তার দ্বীন-ইসলামের মাধ্যমে রহিত হয়ে গেছে-এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য]

এ দুটি বাক্যকে এক সাথে পাঠ করতে বা লিখতে কোনও সমস্যা নাই। যারা বলে, এ দুটি বাক্য এক সাথে লিখা শিরক, বরং উপর নিচে করে লিখতে হবে, অথবা মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ-এর আগে অবশ্যই ‘আন্না’ শব্দ উল্লেখ করতে হবে। না হলে তা শিরক হবে। তাদের এ সব কথাবার্তা চরম পর্যায়ের বাড়াবাড়ি, বিভ্রান্তি মূলক এবং ও দ্বীন সম্পর্কে মূর্খতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। আল্লাহু আলাম।

▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬

আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।