কীভাবে বুঝব বিপদাপদের মধ্যে কোনটা আল্লাহর পরীক্ষা আর কোনটা আল্লাহর শাস্তি

কীভাবে বুঝব, বিপদাপদের মধ্যে কোনটা আল্লাহর পরীক্ষা আর কোনটা আল্লাহর শাস্তি? ইসলামের দৃষ্টিতে বিপদাপদে হা হুতাশ করা এবং অস্থিরতা প্রকাশের বিধান কী?

প্রশ্ন: আল্লাহ কখন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন আর কখন পরীক্ষা নিচ্ছেন তা বোঝার আলামত কী? কখনো যে বিপদে পড়ি, বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হই এবং কষ্টে দিন যায়-এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন নাকি আমাদেরকে পাপের শাস্তি তা কীভাবে বুঝবো? আর ইসলামের দৃষ্টিতে বিপদাপদে হা হুতাশ করা ও অস্থিরতা প্রকাশ করার বিধান কী?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আল্লাহ তাআলা কখনো বান্দাকে তার গুনাহের শাস্তি দেন আবার কখনো তার গুনাহ মোচন ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য রোগ-ব্যাধি ও নানা ধরণের বিপদ-মসিবত দ্বারা পরীক্ষা করেন। এখন এটা বুঝার উপায় কী যে, কোনটা আল্লাহর পরীক্ষা আর কোনটা আল্লাহর শাস্তি?
আলেমগণ বলেন, গুনাহ মোচন ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষার নাকি শাস্তি তা বুঝা যাবে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির আচরণ ও মানসিক অবস্থা থেকে। কেউ যদি রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদে পড়েও আল্লাহর তকদিরের উপর সন্তুষ্ট থাকে, অধৈর্যের পরিচয় না দেয়, আল্লাহর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ না করে, হৈচৈ-চিৎকার-চেঁচামেচি না করে, শত কষ্টেও আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকে এবং তাঁর নাফরমানিতে লিপ্ত না হয় তাহলে বুঝতে হবে, এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে তার গুনাহ মোচন ও আখিরাতে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। কিন্তু যদি সে বিপরীত আচরণ করে অর্থাৎ বিপদ-সংকটে চরম অধৈর্যের পরিচয় দেয়, মানুষের কাছে অভিযোগ করে, আল্লাহর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে অথবা আল্লাহর আনুগত্য থেকে সরে যায় তাহলে বুঝতে হবে, এটি ছিল তার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি স্বরূপ। আল্লাহ আমাদেরকে সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর তকদিরের প্রতি কৃতজ্ঞ ও সন্তুষ্ট থাকার এবং তার আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।

আব্দুল কাদের জিলানি রাহ. বলেন,

علامة الابتلاء على وجه العقوبة والمقابلة: عدم الصبر عند وجود البلاء، والجزع والشكوى إلى الخلق. وعلامة الابتلاء تكفيرا وتمحيصا للخطيئات: وجود الصبر الجميل من غير شكوى، ولا جزع ولا ضجر، ولا ثقل في أداء الأوامر والطاعات. وعلامة الابتلاء لارتفاع الدرجات: وجود الرضا والموافقة، وطمأنينة النفس، والسكون للأقدار حتى تنكشف .اهـ. من طبقات الشعراني

– “শাস্তি এবং বদলা হিসেবে আপতিত বিপদাপদের আলামত হল, ধৈর্য হীনতা ও অস্থিরতা প্রকাশ এবং সৃষ্টির নিকট অভিযোগ করা।
– পাপ থেকে মুক্তির জন্য বিপদাপদের আলামত হল, কোনও অভিযোগ ছাড়া পরম ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া, অস্থিরতা-উৎকণ্ঠা ও বিরক্তি প্রকাশ না করা এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন ও আনুগত্য মূলক কাজকে ভারী মনে না করা।
– আর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আগত বিপদাপদের আলামত হল, বিপদ কেটে যাওয়া পর্যন্ত আল্লাহর তকদিরের প্রতি সন্তুষ্টি ও সম্মতি প্রকাশ করা, মানসিক প্রশান্তি ও স্থিরতা অনুভব করা। [তাবাকাতুশ শারানি]

❑ বিপদে অস্থিরতা ও অশান্ত মনোভাব প্রকাশ করা নিন্দনীয়:

◆ আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا ‎
“যখন তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে হা হুতাশ করে।” [সূরা মায়িদা: ২০]
বিন সাদি উক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন,
فيَجْزَع إن أصابه فقرٌ أو مرضٌ، أو ذهابُ محبوبٍ له، مِن مالٍ أو أهلٍ أو ولدٍ، ولا يستعمل في ذلك الصَّبر والرِّضا بما قضى الله
“মানুষ যদি দরিদ্রতায় পতিত হয় বা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় বা তার ধন-সম্পদ নষ্ট হয় বা সন্তান-পরিবার ইত্যাদি প্রিয়জন মারা যায় তখন সে হা হুতাশ করে। সে এ ক্ষেত্রে আল্লাহ যা ফয়সালা করেছেন সে ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে না এবং ধৈর্যের পরিচয় দেয় না।” [তাসফিরে বিন সাদি]

◆ সাঈদ বিন জুবাইরকে অস্থিরতা বা উৎকণ্ঠা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন,

الجَزَع على نحوين: أحدهما في الخطايا، أن يجزع الرَّجل إليها، والآخر في المصائب، فأمَّا جزع المصيبة: فهو ألَّا يحتسبها العبد عند الله، ولا يرجو ثوابها، ويرى أنَّه سوءٌ أصابه، فذلك الجَزَع

“উৎকণ্ঠা দু প্রকার। একটি হল, মানুষ পাপ কর্ম করার কারণে উৎকণ্ঠিত হয়। আরেকটি হল, বিপদ-মসিবতে উৎকণ্ঠিত হওয়া। বিপদ-মসিবতে অস্থির ও উৎকণ্ঠিত হওয়ার অর্থ হল, (এতে) বান্দা আল্লাহর নিকট সওয়াব লাভের মনোভাব রাখে না এবং প্রতিদানের আশা করে না। মনে করে, সে অকল্যাণের শিকার হয়েছে। এটাই হল, উৎকণ্ঠা।” [ইবনে আবিদ দুনিয়া, ধৈর্য এবং প্রতিদান, পৃষ্ঠা নম্বর ১২৯]

◆ ইমাম ইবনে তায়মিয়া রাহ. বলেন,
الجزع عند المصيبة .. مصيبة اخرى
“বিপদ-মসিবতে উদ্বিগ্ন ও অস্থির হওয়াও একটি মসিবত।”

মোটকথা, আমাদের কর্তব্য, জীবনে যত রোগ-শোক, দুখ-কষ্ট, দরিদ্রতা, ক্ষয়-ক্ষতি, প্রিয়জন হারানোর বেদনা ইত্যাদি আসুক না কেন আমাদেরকে পরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে, আল্লাহর ফয়সালার সামনে আত্মসমর্পণ করতে হবে এবং আল্লাহর আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে তাহলে তা আমাদের জন্য কল্যাণে রূপান্তরিত হবে। এর বিনিময়ে তিনি আমাদের গুনাহ মোচন করবেন, আখিরাতে মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং আমাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন। পক্ষান্তরে আমরা যদি এতে অধৈর্য ও অস্থিরতা প্রকাশ করি, হা হুতাশ করি, আল্লাহর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করি এবং মানুষের কাছে বিপদ-আপদ নিয়ে নানা অভিযোগ ও আক্ষেপ করি তাহলে আমরা আল্লাহর পরীক্ষায় অকৃতকার্য হব বরং তা আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তির আলামত হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ হেফাজত করুন। আমিন।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।