কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নেকির পাল্লা ভারী হবে নাকি গুনাহের পাল্লা ভারী হবে এ দুশ্চিন্তায় বিভোর থাকবেন একথা সঠিক নয়

প্রশ্ন: কোনো এক বক্তব্যে শুনেছি যে, “বিচারের মাঠে যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমলনামা দাঁড়িপাল্লায় উঠানো হবে তখন তিনি চিন্তিত থাকবেন যে, তিনি জান্নাতে যাবেন নাকি জাহান্নামে যাবেন!” অথবা তাঁর নেকির পাল্লা ভারী হবে নাকি গুনাহের পাল্লা ভারী হবে-এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবেন। উপরোক্ত বক্তব্য কি সঠিক?▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: উপরোক্ত বক্তব্য সঠিক নয়। কেননা এ বিষয়ে কোনো সহিহ হাদিস নেই। এর পক্ষে একটি হাদিস বর্ণনা করা হয়ে থাকে কিন্তু সেটিও প্রাজ্ঞ হাদিস বিশারদগণের দৃষ্টিতে জয়িফ বা দুর্বল। বিশেষ করে হাশরের ময়দানে আল্লাহর নবী তাঁর নিজের পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তা গ্রস্থ হওয়ার ব্যাপারে (যা অদৃশ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত) এমন দুর্বল হাদিস কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা বহু বিশুদ্ধ হাদিসে প্রমাণিত যে, তিনি একদিকে দুনিয়াতে জীবদ্দশায় আল্লাহর নিকট থেকে ক্ষমা প্রাপ্ত হয়েছেন, অন্যদিকে কিয়ামতের দিন তিনি বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকার এবং সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসেবে জান্নাতে প্রবেশের সুসংবাদ ও প্রতিশ্রুতি লাভ করেছেন। যদিও আমাদের প্রিয় শাইখ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ (হাফিজাহুল্লাহ) উক্ত দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে বলেছেন যে, কিয়ামতের দিন দাঁড়িপাল্লায় আমলনামা মাপার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবেন আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন যে, তার নেকির পাল্লা ভারী হয় নাকি গুনাহর পাল্লা ভারী হয়?!!
(আল্লাহ শায়খকে ক্ষমা করুন। আমিন
কমেন্টে শাইখের বক্তব্যের লিংক দেওয়া হল)
তাছাড়া উক্ত হাদিসটি অন্যান্য একাধিক সহিহ হাদিস পরিপন্থী।

যেমন: বহু সংখ্যক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, সকল মানুষের মধ্যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্ব প্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন।

এ মর্মে দুটি হাদিস পেশ করা হলো:

▪️ ক. আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« آتِي بَابَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَسْتفْتِحُ، فَيَقُولُ الْخَازِنُ: مَنْ أَنْتَ؟ فَأَقُولُ: مُحَمَّدٌ، فَيَقُولُ: بِكَ أُمِرْتُ لَا أَفْتَحُ لِأَحَدٍ قَبْلَكَ »
“কিয়ামতের দিন আমি জান্নাতের দরজার নিকটে এসে দরজা খুলতে বললে জান্নাতের রক্ষক বলবেন, কে আপনি? আমি বলব: মুহাম্মদ। তিনি বলবেন, আপনার জন্যই দরজা খোলার অনুমতি আছে। আপনার পূর্বে কারও জন্য দরজা খোলার অনুমতি নাই।” [মুসলিম, হাদিস নাম্বার ১৯৮]

▪️খ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,
أَنَا أَوَّلُ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“আমি হলাম সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
[সহিহ জামে তিরমিযী ও মাজমাউয যাওয়ায়েদ। শাইখ আলবানি বলেন, سنده جيد، رجاله رجال الشيخين “এর সনদটি ভালো। আর বর্ণনাকারীগণ সবাই বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনাকারী।” [সহীহাহ, ১০০/৪]

▪️এছাড়াও ‌বহু হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাশরের ময়দানের বিভীষিকাময় কঠিন পরিস্থিতিতে যখন অন্যান্য সকল নবী-রাসুল অপারগতা প্রকাশ করবেন তখন তিনি সমগ্র মানবজাতির পক্ষ থেকে হিসাব-নিকাশ ও বিচার কার্য শুরু করার জন্য মহা বিচারক আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবেন এবং তিনি তা কবুল করবেন। এটাকে বলা হয়, শাফায়াতে উযমা বা সর্ববৃহৎ শাফায়াত। এ কারনেই তিনি মাকামে মাহমুদ বা সর্বজন প্রশংসিত আসনের অধিকারী হবেন। কেননা সকল নবী-রাসূল এবং তাবৎ মানব কুল সেদিন তাঁর প্রশংসা করবে।

আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,
عَسَىٰٓ أَن يَبۡعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامٗا مَّحۡمُودٗا
“আশা করা যায় আপনার রব আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।” [সূরা ইসরার: ৭৯]

▪️জান্নাতের সবচেয়ে মর্যাদা পূর্ণ স্থানের অধিকারী হবেন প্রিয় নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি ছাড়া আর কোন নবী-রাসুল এই মহা সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবেন না। ওই মর্যাদাপূর্ণ স্থানটির নাম, ওসিলা (الوسيلة)‌ যা আজানের দুআর মধ্যে উল্লেখিত হয়েছে।

▪️ বহু সংখ্যক সাহাবি থেকে মুতাওয়াতি সূত্রে প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারের মালিক হবেন। এটি কুরআনের সর্বকনিষ্ঠ সুরা কাউসার-এর প্রথম আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।

🔸আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন আমলনামা ওজনের সময়‌ তিনি জান্নাতি হবেন নাকি জাহান্নামে হবেন বা তার নেকির পাল্লা ভারী হবে, নাকি হালকা হবে- এ ভয়ে ভীত থাকবেন- এ বিষয়ে দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হাদিসটি সহিহ নয়:

হাদিসটি নিম্নরূপ:
عَنِ الْحَسَنِ، عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّهَا ذَكَرَتِ النَّارَ فَبَكَتْ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا يُبْكِيكِ؟ قَالَتْ: ذَكَرْتُ النَّارَ فَبَكَيْتُ، فَهَلْ تَذْكُرُونَ أَهْلِيكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَمَّا فِي ثَلَاثَةِ مَوَاطِنَ فَلَا يَذْكُرُ أَحَدٌ أَحَدًا: عِنْدَ الْمِيزَانِ حَتَّى يَعْلَمَ أَيَخِفُّ مِيزَانُهُ أَوْ يَثْقُلُ، وَعِنْدَ الْكِتَابِ حِينَ يُقَالُ (هَاؤُمُ اقْرَءُوا كِتَابِيَهْ) حَتَّى يَعْلَمَ أَيْنَ يَقَعُ كِتَابُهُ أَفِي يَمِينِهِ أَمْ فِي شِمَالِهِ أَمْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِهِ، وَعِنْدَ الصِّرَاطِ إِذَا وُضِعَ بَيْنَ ظَهْرَيْ جَهَنَّمَ قَالَ: يَعْقُوبُ، عَنْ يُونُسَ وَهَذَا لَفْظُ حَدِيثِهِ ضعيف، المشكاة (٥٥٢٠)
হাসান রহ. বর্ণনা করছেন আয়েশা রা. থেকে। একবার তিনি জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদতে থাকলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কাঁদছো কেন?বতিনি বলেন, জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদছি। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কিয়ামতের দিন আপনার স্ত্রী-পরিবারের কথা স্মরণ করবেন?

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিনটি স্থান এমন আছে, যেখানে কেউ কারো কথা স্মরণ করবে না। যথা:
১. মিজান বা দাঁড়িপাল্লায় বান্দার আমলনামা ওজনের সময়-যতক্ষণ না কেউ জানতে পারবে যে, তার পাল্লা ভারী হবে নাকি হালকা হবে।
২. আমলনামা পাওয়ার সময়, যখন বলা হবে, “এই নাও, তোমরা তোমাদের আমলনামা পাঠ কর-যতক্ষণ না কেউ জানতে পারবে যে, তা কোন দিক থেকে আসে-ডান, বাম না পেছনের দিক থেকে।
৩. এবং সে সময় যখন সে পুলসিরাতের নিকটে থাকবে এবং তা স্থাপিত থাকবে জাহান্নামের উপরে।
[আহমদ ও আবু দাউদ। বর্ণনাকারী হাসান রহ. হাদিসটি আয়েশা রা. থেকে শুনেননি, বিধিয় তা মুরসাল। আর মুরসাল হাদিস জয়িফ (দুর্বল) হাদিসের অন্তর্ভুক্ত। দ্রষ্টব্য: যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম‌ আলবানি এর জয়িফ আবু দাউদ, হা/৭৪৫৫ ও জয়িফ তারগিব, হা/২১০৮]

উপরোক্ত কুরআনের আয়াত, হাদিস এবং আলোচনা থেকে প্রতিমান হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশাতেই হাশরের ময়দানে মহা মর্যাদা পূর্ণ অবস্থানের এবং চিরশান্তির নীড় জান্নাতে প্রবেশের সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এ সুসংবাদ প্রদানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সব ধরনের সংকট ও ভয়-ভীতি থেকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করেছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।

🔸তিনি ছিলেন আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্ত নিষ্পাপ এবং পুতপবিত্র:

মুগিরা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত বেশি সালাত আদায় করতেন যে, তাঁর পদযুগল ফুলে যেতো। তাঁকে জিজ্ঞেস হল, আল্লাহ তো আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন।
তিনি বললেন,
أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا
“আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না?”
[সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) অধ্যায়: ৫২/ তাফসীর, পরিচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী:
ليغفر لك الله ما تقدم من ذنبك وما تأخر ويتم نعمته عليك ويهديك صراطا مستقيما
“যেন আল্লাহ্‌ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমার প্রতি তার অনুগ্রহ পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন (৪৮: ২)]
সুতরাং এইসব দলিলের আলোকে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে, কিয়ামতের দিন বান্দার হিসাব-নিকাশ এবং আমলনামা ওজনের সময় ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতি হবেন না কি জাহান্নামি হবেন’ কিংবা ‘তাঁর নেকি পাল্লা ভারী হবে, নাকি গুনাহের পাল্লা ভারী হবে’-এমন দু:শ্চিন্তায় পতিত হবেন না। অতএব যে বক্তা এমন কথা বলেছে তার বক্তব্য সঠিক নয়।
الله اعلم
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।