ইসলামে যৌবনকালের গুরুত্ব এবং তার মেয়াদকাল

প্রশ্ন: ইসলামে যৌবনকালের গুরুত্ব কি এবং যৌবনকালের মেয়াদ কত দিন? (যৌবন কত বছর বয়স থেকে শুরু হয় এবং কত বছরে শেষ হয়)

উত্তর:
আমাদের অজানা নয় যে, মানব জীবনে একাধিক ধাপ রয়েছে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য। এগুলোর মধ্যে যৌবনকাল হল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় কালটাকে বলা হয়, Golden age of life বা জীবনের সোনালী অধ্যায়। এটি মানুষের ব্যক্তিত্ব ও ক্যারিয়ার গঠন, জ্ঞানার্জন, অর্থ উপার্জন, বিয়ে-দাম্পত্য, পরিবার, নেতৃত্ব, যুদ্ধ-সংগ্রাম ও ইবাদতের প্রকৃত সময়। এ সময়কে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগালে একজন মানুষ যেমন সফল ও আলোকিত মানুষে পরিণত হয় ঠিক তেমনটি সামান্য অবহেলা ও অযত্নে যৌবনের উন্মাদনায় হারিয়ে যেতে পারে পাপ-পঙ্কিলতার অতল তলে, নিক্ষিপ্ত হতে পারে ধ্বংস ও অন্ধকারের অতল গহ্বরে। যৌবন হল এক অমিত শক্তির নাম, যাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে জীবন-সংসার সৃষ্টি-সৌন্দর্যে মহনীয় হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে যৌবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেলে তার তাণ্ডবলীলায় জীবন ও জগত নরকে পরিণত হয়।

সে কারণে হাদিসে যৌবনকালকে গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারে পর্যাপ্ত তাকিদ এসেছে এবং যৌবনকালে আল্লাহর ইবাদতের বিশেষ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে।

জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকাল সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن ضَعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً يَخْلُقُ مَا يَشَاء وَهُوَ الْعَلِيمُ الْقَدِيرُ
“আল্লাহ তিনি দুর্বল (শিশু) অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন অতঃপর দুর্বলতার পর (যৌবনে) শক্তি দান করেছেন, অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ [সূরা রূম: ৫৪]

ইসলামে‌ যৌবনকালের বিশেষ গুরুত্ব সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঁচটি জিনিসকে গনিমতের সম্পদ হিসেবে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তম্মধ্যে অন্যতম হল, যৌবন কাল। তিনিও আরও সতর্ক করেছেন যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাঠগড়ায় আদমের সন্তানদেরকে এক পাও এগুতে দেয়া হবে না যতক্ষণ না তাকে চারটি প্রশ্ন করা হবে। তম্মধ্যে একটি হল, যৌবন কাল। যে যুবক যৌবন কালকে আল্লাহর ইবাদতে কাটাতে সক্ষম হয় তাকে কিয়ামতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এভাবে ইসলামে জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টির প্রতি যত্নবান হতে যথেষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

হাফসা বিনতে সিরিন রাহ. (বিশিষ্ট মহিলা ফকিহ ও তাবেয়ী) বলতেন,
يا معشر الشباب! خذوا من أنفسكم وانتم شباب، فإنى رأيت العمل في الشباب
“হে যুব সম্প্রদায়, তোমরা যৌবন কালেই যথাসাধ্য কাজ করো। কেননা, আমি মনে করি, কাজের প্রকৃত সময় হল, যৌবনকাল।” [সাফওয়াতুস সাফওয়া-ইবনুল জাওযী]

❑ যৌবনের সূচনা ও সমাপ্তি কখন?

ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ উভয়ের শরীরে কিছু বিশেষ চিহ্ন প্রকাশ পাওয়াকে যৌবনের সূচনা কাল হিসেবে ধরা হয়। (যে চিহ্নগুলো সুপরিচিত)। তবে কোন কারণে যৌবনের চিহ্ন প্রস্ফুটিত হতে বিলম্ব হলে হাদিসে ১৫ বছর বয়সের ব্যক্তিকে ‘প্রাপ্ত বয়স্ক’ (adult) হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু যৌবনের সর্বশেষ কোন মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় নি। সে কারণে ইসলামি স্কলারগণ এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনও সময়-সীমার উপর একমত হন নি।

তবে অনেকে চল্লিশ বছরকে যৌবনের চূড়ান্ত মেয়াদ হিসেবে গণ্য করেছেন। তাইতো আমাদের পূর্বসূরিগণ চল্লিশ বছর বয়স অতিবাহিত হলে, আরও অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগীর দিকে ঝুঁকে পড়তেন।

আর বাস্তবতা হল, চল্লিশ বছর বয়সে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়ায়-উৎরায় পার হয়ে অসংখ্য অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষের জ্ঞান-গরিমার পূর্ণতা পায়। তাই তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবুওয়তের গুরু দায়িত্ব প্রদান করা হয় যখন তার বয়স চল্লিশ। বরং সকল নবী-রাসূল যৌবন বয়সে নবুওয়ত লাভ করেছিলেন। যেমন:

ইবনে আব্বাস রা. এর বলেন,
ما بعث اللهُ نبيًّا إلَّا وهو شابٌّ ، ولا أُوتيَ العلمَ عالمٌ إلَّا وهو شابٌّ
‘আল্লাহ তায়ালা সব নবীকে যৌবনকালে নবুয়ত দান করেছেন, যৌবনকালেই আলেমদের ইলম প্রদান করা হয়।’ [তাবারানি, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, বায়হাকি। সূয়ুতী বলেন, إسناده جيد “এর সনদ ভালো।” দ্রষ্টব্য: আন নুকাত আলাল মাউযুআত, পৃষ্ঠা ৪৫]

এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা ৪০ বছর বয়সের কথা উল্লেখ করার বিষয়টি হয়ত কোনও তাৎপর্য বহন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا ۖ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا ۖ وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا ۚ حَتَّىٰ إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِينَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَىٰ وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي ۖ إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়তে লেগেছে ত্রিশ মাস। অবশেষে সে যখন শক্তি-সামর্থ্যে বয়সে ও চল্লিশ বছরে পৌছেছে, তখন বলতে লাগল, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে এরূপ ভাগ্য দান কর, যাতে আমি তোমার নেয়ামতের শোকর করি, যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকাজ করি। আমার সন্তানদেরকে সৎকর্ম পরায়ণ কর, আমি তোমার প্রতি তওবা করলাম এবং আমি আজ্ঞাবহদের অন্যতম।” [সূরা আহকাফ: ১৫]

তবে শারীরিক শক্তিমত্তা, সক্ষমতা , সুস্থতা, শৌর্য-বীর্য, ইত্যাদি ভেদে চল্লিশ বছরের পরেও অনেক মানুষ পূর্ণ যৌবন দীপ্ত জীবন উপভোগ করে।
সুতরাং যৌবনকালকে নির্দিষ্ট বয়স সীমায় সীমাবদ্ধ করা যাবে না। বরং যত দিন একজন মানুষ তার শরীরে যৌবনের উত্তাপ এবং শারীরিক ও মানসিক শক্তি অনুভব করবে ততদিনই সে যুবক। তা চল্লিশের পরও হতে পারে। তাই তো প্রখ্যাত হাদিস ব্যাখ্যাকার মোল্লা আলী কারী রাহ. বলেন,
شَبَابَكَ أَيْ: زَمَانَ قُوَّتِكَ عَلَى الْعِبَادَةِ
“তোমার যৌবন কাল।” অর্থাৎ যতদিন তুমি ইবাদতে শক্তি পাও।” [মিরকাতুল মাফাতীহ, কিতাবুর রিকাক। পাঁটটি জিনিসকে গনিমতের সম্পদ হিসেবে গ্রহণ করা সংক্রান্ত হাদিসের ব্যাখ্যা]

মহান আল্লাহ আমাদের জীবনকে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন করুন, আমাদের যুব সমাজকে সকল পাপাচার ও অকল্যাণের হাত থেকে রক্ষা করুন এবং পরকালে আমাদেরকে প্রবেশ করান মুক্তি ও শান্তির ঠিকানা জান্নাতুল ফিরদাউসে। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◢◯◣▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।