ইসলামে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য এবং তার সাথে অন্যায়-আচরণের ভয়াবহতা

প্রশ্ন: কেউ প্রতিবেশীকে কষ্ট দিলে, তার সাথে প্রতারণা করলে, তার টাকা-পয়সা নিয়ে ষড়যন্ত্র করলে বা তার সাথে হিংসা ও শত্রুতা পোষণ করলে দুনিয়া ও আখিরাতে তার পরিণতি কী হবে?
উত্তর:
ইসলাম এমন একটি মহান জীবনাদর্শের নাম যা মানুষকে সব সময় কল্যাণের পথ দেখায়, কল্যাণের পথে চলতে উৎসাহিত করে এবং প্রতিটি মানুষের অধিকার বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়। তাই নিম্নে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের কী দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে এবং তার অধিকারগুলো কী সে সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল:

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবেশীর প্রতি বেশি কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য ও হক রয়েছে-যেগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রতিটি মুসলিম নির্দেশিত।

◈ এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا
“আর ইবাদত কর আল্লাহর এবং তার সাথে অন্য কাউকে শরিক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতিম-মিসকিন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিত জনকে।” [সূরা নিসা: ৩৬]

◈ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‏ مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِي بِالْجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ لَيُوَرِّثَنَّهُ ‏
“জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে এমনভাবে জোর দিয়ে নির্দেশ দেন যে, আমি ধারণা করছিলাম যে, তাকে সম্পদের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিবেন।”
[সহীহ মুসলিম,৪৭/ সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ৪২. প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে জোরদারের নির্দেশ এবং তার প্রতি সদ্ব্যবহার প্রসঙ্গ]

◈ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا، أَوْ لِيَصْمُتْ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُؤْذِ جَارَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ ‏‏
“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে নয়তো নীরব থাকে। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ৬৮/ কোমল হওয়া, পরিচ্ছেদ: ২৭০৫. জবান সাবধান রাখা। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে। আল্লাহর বাণী: যে কথাই মানুষ উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তার নিকটে একজন সদা তৎপর প্রহরী রয়েছে।]

◈ তিনি আরও বলেছেন,
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُّحِبَّ اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَوْ يُحِبَّهُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ فَلْيُصْدِقْ حَدِيْثَهُ إِذَا حَدَّثَ وَلِيُؤَدِّ أَمَانَتَهُ إِذَا اُؤْتُمِنَ وَلِيُحْسِنْ جِوَارَ مَنْ جَاوَرَهُ-
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা পেতে চায সে যেন সদা সত্য কথা বলে, আমানত রক্ষা করে এবং প্রতিবেশীর উপকার করে।” [মিশকাত হা/৪৯৯০, সনদ হাসান]
কুরআন-হাদিসে প্রতিবেশী সম্পর্কে এমন আরও বহু নির্দেশনা এসেছে।

❑ নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু পয়েন্ট অতি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হল:

১. প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেওয়া
২. প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ না করা
৩. প্রতিবেশীকে নির্যাতন করে গৃহত্যাগে বাধ্য না করা
৪. প্রতিবেশীকে হাদিয়া (উপহার) দেওয়া
৫. প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে ভুরি ভোজ না করা
৬. প্রতিবেশীর দাওয়াত কবুল করা
৭. প্রতিবেশীর সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখা
৮. প্রতিবেশীর জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু হেফাজত করা
৯. প্রতিবেশীর দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা
১০. প্রতিবেশীর প্রতি অনুগ্রহ করা ও তাকে কর্যে হাসানা প্রদান করা
১১. প্রতিবেশীর দুঃখ-শোকে সান্ত্বনা দেওয়া
১২. প্রতিবেশীর জানাজায় অংশগ্রহণ
১৩. প্রতিবেশীর মৃত্যু হলে তার পরিবারের জন্য খাদ্য সরবরাহ করা
১৪. প্রতিবেশীদের মাঝে ন্যায়বিচার করা ইত্যাদি। [পয়েন্টগুলো at-tahreek থেকে সংগৃহীত]

❑ প্রতিবেশীর অধিকার লঙ্ঘন এবং তার প্রতি অন্যায় আচরণের ভয়াবহতা:

কেউ যদি প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়, তার সাথে প্রতারণা করে, তার জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি করে, তার বিরুদ্ধে শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র করে অথবা হিংসা, অন্যায় গালাগালি বা বিভিন্নভাবে অন্যায়-অবিচার করে তাহলে নি:সন্দেহে সে প্রতিবেশীর অধিকার লঙ্ঘন করলো। এ কারণে সে আল্লাহর কাছে অপরাধী ও গুনাহগার বলে গণ্য হবে। সুতরাং সে যে ধরণের অন্যায় করবে আল্লাহ তাআলা সে অনুযায়ী তাকে শাস্তি দিবেন-দুনিয়াতেও হতে পারে- আখিরাতেও হতে পারে।

যেমন: যদি কোনও প্রতিবেশী বা তার পার্শ্বস্থ ব্যক্তিকে গালাগালি করে বা তাকে প্রহার করে বা তার অর্থ-সম্পদ চুরি করে বা প্রতারণার মাধ্যমে তার মান-সম্মান হানী বা অর্থ সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি করে তাহলে আল্লাহ তাআলা আখিরাতের মহাবিচার দিবসে তার নেকিগুলো এই নিপীড়িত ব্যক্তিকে দান করবেন এবং তার গুনাহগুলো ওই অত্যাচারী প্রতিবেশীর উপর চাপিয়ে দিবেন। যেমন:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত,
أَتَدْرُونَ ما المُفْلِسُ؟ قالوا: المُفْلِسُ فِينا مَن لا دِرْهَمَ له ولا مَتاعَ، فقالَ: إنَّ المُفْلِسَ مِن أُمَّتي يَأْتي يَومَ القِيامَةِ بصَلاةٍ، وصِيامٍ، وزَكاةٍ، ويَأْتي قدْ شَتَمَ هذا، وقَذَفَ هذا، وأَكَلَ مالَ هذا، وسَفَكَ دَمَ هذا، وضَرَبَ هذا، فيُعْطَى هذا مِن حَسَناتِهِ، وهذا مِن حَسَناتِهِ، فإنْ فَنِيَتْ حَسَناتُهُ قَبْلَ أنْ يُقْضَى ما عليه أُخِذَ مِن خَطاياهُمْ فَطُرِحَتْ عليه، ثُمَّ طُرِحَ في النَّارِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমরা কি জান নি:স্ব কে?”
সাহাবায়ে কেরাম বললেন: “আমাদের মধ্যে নি:স্ব তো সে যার কোন দিনার-দিরহাম বা অর্থ-সম্পদ নেই।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
“আমার উম্মতের মধ্যে সত্যিকার নি:স্ব হল সেই ব্যক্তি যে, কেয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম ও যাকাতসহ অনেক ভাল কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে অথচ দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো প্রতি অপবাদ দিয়েছিল, করো সম্পদ আত্মসাত করেছিল, কারো রক্তপাত ঘটিয়েছিল, কাউকে মারধোর করেছিল। ফলে তার থেকে নেক আমলগুলো নিয়ে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাওনা আদায় করা হবে।
এভাবে যখন তার নেক আমলগুলো শেষ হয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়ার জন্য আর কিছু থাকবে না তখন তাদের পাপগুলো তাকে দেয়া হবে। ফলে সে (নিঃস্ব অবস্থায়) জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।” [সহিহ মুসলিম]

এভাবে হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি যত প্রকার অন্যায় আছে আল্লাহ তাআলা প্রতিটি অন্যায়ের সূক্ষ্ম বিচার করবেন ইনশাআল্লাহ। নিশ্চয় আল্লাহ সবচেয়ে বড় ন্যায়পরায়ণ বিচারক।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রতিবেশী সহ প্রতিটি মানুষের অধিকার বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।