ইসলামের দৃষ্টিতে হস্তমৈথুন

প্রশ্ন: মাস্টারবেট বা হস্তমৈথুন করার বিধান কী?
উত্তর:
ইসলাম অত্যন্ত স্বভাবজাত ও বাস্তবসম্মত একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শের নাম। এখানে মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সুন্দরতম সমাধান রয়েছে। আর মানুষের জৈবিক চাহিদা যেহেতু তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সেহেতু এক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে-এটাই স্বাভাবিক।

আর তাইতো এই মহাবিশ্বের মহাপরিচালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষকে তার জৈবিক বাসনা পূর্ণ করার পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যেমন:
মহা-গ্রন্থ আল কুরআনে তিনি বলেন,
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ ‎‏ إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ ‎
“এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। অতঃপর কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমালঙ্ঘন কারী হবে।” [সূরা আল মুমিনূন: ৫, ৬ ও ৭]
অর্থাৎ মানুষের যৌন চাহিদা পূরণের বৈধ পন্থা হল, দুটি। যথা:
🔹১. বিয়ের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন গঠন। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা প্রয়োজনবোধে শর্তসাপেক্ষে একসাথে সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
فَٱنكِحُواْ مَا طَابَ لَكُم مِّنَ ٱلنِّسَآءِ مَثۡنَىٰ وَثُلَٰثَ وَرُبَٰعَۖ فَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا تَعۡدِلُواْ فَوَٰحِدَةً أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡۚ ذَٰلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَلَّا تَعُولُواْ
“অতএব তোমরা বিয়ে করো নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন বা চার ; আর যদি আশংকা কর যে সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকেই বা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকেই গ্রহণ কর। এতে পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভাবনা বেশী।
[সূরা নিসা: ৩]

🔹 ২. কাফেরদের সাথে সংঘটিত জিহাদের মাধ্যমে গনিমত হিসেবে প্রাপ্ত নারী বন্দি বা ক্রীতদাসী। (বর্তমানে দাস-দাসী প্রথা প্রচলিত নেই। বিধায় এখানে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো না)

উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখিত দুটি উপায়ের বাইরে লজ্জাস্থানের ব্যবহারকে ‘সীমালঙ্ঘণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখান থেকেই ইমাম শাফেয়ী রহ. সহ অনেক সম্মানিত ফকিহ, হাত বা অন্য কোনও উপায়ে বীর্য স্খলন ঘটানোকে হারাম বলেছেন।

নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য এই বিধান প্রযোজ্য।

🔸 সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন,
العادة السرية لا تجوز وهي الاستمناء باليد أو بغيرها من الآلات لا يجوز؛
“হস্তমৈথুন তথা হাত অথবা অন্য যন্ত্র দ্বারা বীর্য স্খলন ঘটানো জায়েজ নয়।” এরপর তিনি হস্তমৈথুনে অভ্যস্ত হওয়ার বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করেন। (শাইখের এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট)

🔸 শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানিও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। তবে তিনি বলেন, হস্ত মৈথুন ‘অভিশাপ যোগ্য কর্ম’ হওয়ার ব্যাপারে কিছু হাদিস পাওয়া যায়। সেগুলো ভিত্তিহীন এবং এমন দুর্বল যা দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন,
من نكح بيده ملعون أو ناكح كفه ملعون. فهذا الحديث لا أصل له، نعم هناك حديث بمعناه ( سبعة لعنهم الله ومنهم ناكح يده ) لكنه حديث ضعيف الإسناد لا تقوم فيه حجة، ولذلك هو مذكور في كتابي ( ضعيف الجامع الصغير )
“যে তাঁর হাতকে বিয়ে করবে সে অভিশপ্ত অথবা হাতের তালুকে বিয়ে কারী অভিশপ্ত।” এর কোনও ভিত্তি নেই। হ্যাঁ, এর সমার্থবোধক একটি হাদিস রয়েছে। তা হল, “আল্লাহ সাত শ্রেণীর মানুষের প্রতি অভিসম্পাত করেন। তাদের মধ্যে একজন হল, হাতকে বিবাহ কারী।” কিন্তু এর সনদ দুর্বল যা দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। [যাঈফ আল জামে আস সাগীর]

এছাড়াও হস্তমৈথুন বিয়ের মাধ্যমে হালাল পন্থায় সন্তান লাভের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক এবং আল্লাহর চিরাচরিত নিয়ম পরিপন্থী। কেননা কোন মানুষ এই হারাম কর্মে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সে বিয়ের প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এমনকি অতিরিক্ত অবিচারের ফলে তার বিয়ের শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় যেমনটি ডাক্তারগণ সতর্ক করেছেন।

◾এবার দেখা যাক, হস্তমৈথুনের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন কী বলেন:

pnsnews24 এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়:

হস্তমৈথুন এমন একটি অভ্যাস যা একবার কাউকে পেয়ে বসলে ত্যাগ করা খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, অভ্যাসটি এক সময় অনেকের যৌন জীবন বিপর্যস্ত করে তুলে। হস্তমৈথুনের কারণে দুই ধরনের সমস্যা হয়- মানসিক সমস্যা ও শারীরিক সমস্যা।

অতিরিক্ত হস্তমৈথুনের ফলে যে ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে:

১. অকাল বীর্যপাত(Premature Ejaculation)। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ে বীর্যপাত ঘটে। ফলে স্বামী তার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে অক্ষম হয়। বৈবাহিক সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয় না।

২. বীর্য পাতলা হয়ে যায় (Temporary Oligospermia)- Oligospermia হলে বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যায়। তখন বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা হয় ২০ মিলিয়নের কম। যার ফলে Male infertility দেখা দেয়। অর্থাৎ সন্তান জন্মদানে ব্যর্থতা দেখা দিতে পারে। একজন পুরুষ যখন স্ত্রীকে রমণ করেন তখন তার পুরুষাঙ্গ থেকে যে বীর্য বের হয় সেই বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা হয় ৪২ কোটির মত।

৩. বিজ্ঞান বলে, কোনও পুরুষের থেকে যদি ২০ কোটির কম শুক্রাণু বের হয় তাহলে সে পুরুষ কোনও সন্তানের জন্ম দিতে পারেন না। অতিরিক্ত হস্তমৈথুন পুরুষের যৌনাঙ্গকে দুর্বল করে দেয়।

৪. Nervous system, heart, digestive system, urinary system এবং আরও অন্যান্য system ক্ষতিগ্রস্ত হয় । পুরো শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং শরীর রোগ-বালাইয়ের যাদুঘর হয়ে যায়।
৫. চোখের ক্ষতি হয়।
৬. স্মরণ শক্তি কমে যায়।
৭. মাথা ব্যথা হয় ইত্যাদি আরও অনেক সমস্যা হয় হস্তমৈথুনের কারণে।
৮. আরেকটি সমস্যা হল Leakage of semen। অর্থাৎ সামান্য উত্তেজনায় যৌনাঙ্গ থেকে তরল পদার্থ বের হওয়া।
৯. শারীরিক ব্যথা এবং মাথা ঘোরা।
১০. যৌন ক্রিয়ার সাথে জড়িত স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হওয়া অথবা ঠিক মত কাজ না করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া।
১১. শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন: হজম প্রক্রিয়া এবং প্রস্রাব প্রক্রিয়ায় সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রুত বীর্য স্খলনের প্রধান কারণ অতিরিক্ত হস্তমৈথুন।
১২. হস্তমৈথুনের ফলে অনেকেই কানে কম শুনতে পারেন। [পিএনএস ডেস্ক]

সুতরাং সামর্থ্য বান যুবকদের অনতিবিলম্বে বিয়ে করা উচিত। পাপাচারে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলে বিয়ে করা ফরজ। হ্যাঁ, বিশেষ কোন কারণে বিয়েতে সাময়িক বিলম্ব হলে রোজা রাখার মাধ্যমে যৌন বাসনা কে দমন করবে। যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন,
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ؛ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ.
“হে যুব সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে চোখকে নিচু রাখতে এবং লজ্জা স্থানকে সংযত করতে সব চেয়ে বেশি সহায়ক। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন সওম (রোজা) পালন করে। কেননা তা প্রবৃত্তিকে দমন করে।” [বুখারী ১৯০৫, ৫০৬৫ ও মুসলিম ১৪০০]

কিন্তু ক্যারিয়ার গঠন, চাকরি পাওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, বয়স হয়নি, বউকে কী খাওয়াবো এসব দুর্বল ও কু যুক্তি পেশ করে হালাল বিয়ে থেকে দূরে থাকা এবং তথাকথিত বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড নামক ঘৃণ্য অপসংস্কৃতিতে হাবুডুবু খাওয়া অথবা পর্ণ, ও যৌন উত্তেজক ভিডিও দেখা, এই জাতীয় গান শোনা, অশ্লীল ও নোংরা গল্প-উপন্যাস পড়া কিংবা কারো সাথে অশ্লীল কথাবার্তা বলার মাধ্যমে যৌন উত্তেজনা অনুভব করা অবশেষে হস্তমৈথুনের মাধ্যমে যৌন চাহিদা নিবৃত করে নিজের উপর অত্যাচার করা এবং তাকে অভ্যাসে পরিণত করা নিঃসন্দেহে হারাম ও কবিরা গুনাহ।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হালাল পন্থায় জৈবিক চাহিদা পূরণ করার এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম
▬▬▬✪✪✪▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।