ইসলামের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ বলার বিধান কি?

প্রশ্ন: ইসলামের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ বলার বিধান কি? সূরা হজের ৭৮ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের ধর্মে কায়েম থাক।” তাহলে শেখ মুজিবুর রহমানকে যারা ‘জাতির পিতা’ বলে তারা কি ঈমান হারা হয়ে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায় নি?
উত্তর:
এখানে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি আমাদের জানা জরুরি তা হল, সম্মান প্রদর্শনার্থে কোন সম্মানিত ব্যক্তিকে পিতা, জনক, বাবা ইত্যাদি বলা নিষিদ্ধ কি না বা এতে গুনাহ হবে কি না?
উত্তর হল, না এটা নিষিদ্ধ নয় এবং এতে কোন গুনাহও নাই। তবে অন্য কাউকে জন্মদাতা পিতা বলে দাবি করা হারাম-যেমনটি জাহেলি যুগে প্রচলিত ছিল। ইসলামে এই কু প্রথাকে উৎখাত করেছে। যেমন হাদিসে এসেছে, সাদ ইবনে আবী অক্কাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«من ادعى إلى غير أبيه وهو يعلم أنه غير أبيه، فالجنة عليه حرام» . متفق عليه
”যে ব্যক্তি নিজ পিতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলে দাবী করে , অথচ সে জানে যে, সে তার পিতা নয়, তার জন্য জান্নাত হারাম। ” (বুখারি ও মুসলিম) এ বিষয়ে আরও একাধিক হাদিস রয়েছে।
আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দাবী করা এবং শুধু সম্বোধন করার মধ্যে পার্থক্য আছে। দাবী করা হারাম পক্ষান্তরে সম্বোধন করা জায়েজ।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত পড়ুন:
নিজের জন্মদাতা বাবা/মা ছাড়া অন্য কাউকে বাবা/মা বলা জায়েজ আছে কি?
যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে ‘জাতির জনক বা জাতির পিতা’ বলে সম্বোধন করে তাদের উদ্দেশ্যে, তিনি বাঙ্গালী জাতির পিতা। (সমগ্র মুসলিম জাতির পিতা বলা তাদের উদ্দেশ্য নয়) এবং তারা তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে এমনটি বলে থাকে। কারণ তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের নির্দেশ দাতা। তার আহ্বানেই ১৯৭১ সনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো এবং দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিলো।
যদিও আমার দৃষ্টিতে তাকে ‘জাতির পিতা’ বলতে হলে ‘বাংলাদেশী জাতির পিতা’ বলা অধিক যুক্তি সঙ্গত। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বিশাল বাঙালী জনগোষ্ঠী রয়েছে। তারা কোনোভাবেই শেখ মুজিবর রহমানকে জাতির পিতার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক অবাঙালীও বসবাস করে। যেমন: চাকমা, সাঁওতাল, গারো, খাসিয়া, মুরং ইত্যাদি। তিনি কি এসব অবাঙালী বাংলাদেশীদের শ্রদ্ধার পাত্র নন?
যাহোক, সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কোন সম্মানিত ব্যক্তি, মুরব্বি ও বয়স্ক লোক, বুজুর্গ, রাষ্ট্রপ্রধান, জাতীয় নেতা ইত্যাদিকে পিতা বা জনক বলা শরিয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর নয় এবং তা আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম অথবা মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহিম আলাইহিস সালাম অথবা নিজের জন্মদাতা পিতাকে পিতা বলার সাথে সাংঘর্ষিকও নয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে জাতীয় নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধানকে পিতা হিসেবে সম্বোধন করার প্রচলন রয়েছে। যেমন: পাকিস্তানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ন, মালয়েশিয়ায় টুংকু আব্দুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে জাতির পিতা বলার মাধ্যমে সম্মান প্রদান করা হয়। সৌদি আরবের আলেম-উলামা ও সাধারণ জনগণ তাদের শাসককে আল ওয়ালেদ (পিতা) হিসেবে সম্বোধন করে। তাছাড়া আরবের বিভিন্ন গোত্রে তাদের গোত্র প্রধান ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে ‘পিতা’ বলে সম্বোধন করার প্রচলন রয়েছে কিন্তু পৃথিবীর কোন আলেম এটিকে হারাম বা শরিয়া বিরোধী বলে ফতোয়া দিয়েছেন বলে জানা নাই।
মোটকথা, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে জাতির জনক বা জাতির পিতা বলা শরিয়ার দৃষ্টিতে আপত্তি জনক নয়। তবে আপত্তি জনক হল, তার প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে বর্তমানে একশ্রেণীর মানুষ বাড়াবাড়ি পর্যায়ের অন্ধভক্তির পরিচয় দিচ্ছে। ‌এরা এমন কিছু কার্যক্রম করছে যা আল্লাহর সাথে শিরকের মাধ্যম অথবা সরাসরি শিরক ও বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। যেমন: রাস্তার মোড়ে মোড়ে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তার মূর্তি বা ভাস্কর্য স্থাপন, মিলাদ ও দুআ মাহফিলের মাধ্যমে মূর্তির মোড়ক উন্মোচন, স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তার ছবিতে হাত লাগিয়ে আশীর্বাদ গ্রহণে বাধ্য করা, সরকারী বা বেসরকারি অফিস-আদালতে তার ছবি টানানোকে বাধ্যতা মূলক করা, শিয়াদের অনুকরণে ‘হায় মুজিব, হায় মুজিব’ বলে শরীরে চাবুকের আঘাত করা, টাকার মধ্যে ছবি সংযোজন করা, তার ছবি বা মূর্তিতে ফুলের মালা দেয়া ও স্যালুট করা, তার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি মূলক গান, কবিতা ও‌ কথাবার্তা বলা ইত্যাদি।
❑ মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করা নিষিদ্ধ। কারণ তা শিরকের মাধ্যম ও ধ্বংসের কারণ:
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে গিয়ে সীমালঙ্ঘন বা অতিরঞ্জন করা বৈধ নয়। কেননা, পৃথিবীতে শিরকের উৎপত্তি ঘটেছিলে নূহ আলাইহিস সালাম এর যুগের পাঁচ জন সম্মানিত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার কারণে। প্রথম পর্যায়ে তারা তাদেরকে দেখে অনুপ্রেরণা লাভের উদ্দেশ্যে কেবল তাদের মূর্তি নির্মাণ করেছিলো। কিন্তু কাল পরিক্রমায় মানুষ সে সকল মূর্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, বিপদাপদে সাহায্য প্রার্থনা, আশীর্বাদ ও বরকত গ্রহণ এবং ক্রমান্বয়ে সরাসরি সেজদা সেজদা ও পূজা-অর্চনা শুরু করেছিলো। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন সূরা নূহ এর ২৩ নং আয়াতের তাফসির।
✪ ওমর রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لاَ تُطْرُونِي ، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ ، فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ ، وَرَسُولُهُ
‘‘তোমরা আমার মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করোনা যেমনি ভাবে প্রশংসা করেছিলো খৃষ্টানরা মরিয়ম তনয় ঈসা (আঃ) এর। আমি আল্লাহ তাআলার বান্দা মাত্র। তাই তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তাঁরই রাসূল বলবে।’’ (বুখারি ও মুসলিম)
✪ হাদিসে আরও বর্ণিত হয়েছে,
عن عبد الله بن عباس -رضي الله عنهما- قال: قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: “إياكم والغُلُوَّ؛ فإنما أهلك من كان قبلكم الغُلُوُّ”.
[صحيح.] – [رواه ابن ماجه وأحمد.]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘‘তোমরা বাড়া-বাড়ি ও সীমা অতিক্রমের ব্যাপারে সাবধান থাকো। কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো সীমা লঙ্ঘন করার ফলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।’’ (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ প্রমুখ-সহিহ)
✪ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«هَلَكَ المُتنَطِّعونَ» قالها ثلاثًا. رواه مسلم
‘‘সীমা লঙ্ঘন কারীরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।’’ এ কথা তিনি তিনবার বলেছেন। (সহিহ মুসলিম)
পরিশেষে বলব, মানুষকে তার প্রাপ্য সম্মান দিন কিন্তু বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন থেকে সাবধান হোন। অন্যথায় সময়ের ব্যবধানে মানুষ অতিভক্তির কারণে এমন কিছু করবে যা তাদেরকে দ্বীন থেকে বের করে দিবে-যার পরিণতি অত্যন্ত খারাপ। আল্লাহ আমাদেরকে সুপথ দেখান এবং এর উপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন মৃত্যু অবধি। আল্লাহু আলাম।
(দয়া করে, শরঈ মাসআলাকে রাজনৈতিক রং লাগিয়ে ঝগড়া করতে করতে না আসার জন্য অনুরোধ রইল)
আরও পড়ুন: প্রশ্ন: জাতির পিতা কে? ইবরাহিম (আ.) না কি আদম (আ.)?
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।