ইসলামের দৃষ্টিতে দাড়ি রাখার গুরুত্ব ও বিধান

ইসলামের দৃষ্টিতে পুরুষদের জন্য দাড়ি রাখা আদর্শিক দৃষ্টিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ। কিন্তু বিধানগত ভাবে তা ফরজ/ওয়াজিব এবং দাড়ি কাটা, ছাটা এবং মুণ্ডণ করা হারাম।

এতে মহান আল্লাহর নাফরমানি এর পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশ অমান্য করা হয় এবং তাঁর নিষেধ লঙ্ঘন করা হয়। তা ছাড়া আল্লাহর রাসুলের আদেশ-নিষেধকে অবমূল্যায়ন করা নি:সন্দেহে তার প্রতি ভালবাসার পরিপন্থী এবং রাসূল প্রেমের নামে কপটতা।

❑ দাড়ি সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস:

● আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন,
أَنَّهُ أَمَرَ بِإِحْفَاءِ الشَّوَارِبِ وَإِعْفَاءِ اللِّحْيَةِ. (مسلم ـ الطهارة ـ حديث 53)
“আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোচ কাটার ও দাড়ি লম্বা করার আদেশ করেছেন।” (সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: পাক-পবিত্রতা)

● তিনি আরও বলেছেন,
خَالِفُوا المُشْرِكِينَ: وَفِّرُوا اللِّحَى، وَأَحْفُوا الشَّوَارِبَ
“মুশরিকদের বিরোধিতা কর, দাড়ি বাড়াও এবং মোচ কাট।” [আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে বুখারি ২/৮৭৫]

● অন্য হাদিসে এসেছে,
ﺧﺎﻟﻔﻮﺍ ﺍﻟﻤﺸﺮﻛﻴﻦ، ﻭﺍﺣﻔﻮﺍ ﺍﻟﺸﻮﺍﺭﺏ ﻭﺃﻭﻓﻮﺍ ﺍﻟﻠﺤﻰ
“মুশরিকদের বিরোধিতা কর- দাড়ি পূর্ণ কর এবং মোচ কাট।” [ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে মুসলিম ১/১২৯]

● তিনি আরও বলেন,
أنهِكوا الشوارِبَ، وأعفُوا اللِّحَى
“মোচ উত্তমরূপে কাট এবং দাড়ি ছেড়ে কর।” [ইবনে ওমর রা. থেকে মারফু সূত্রে সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

● হাদিসে আরও এসেছে:
جُزُّوا الشَّوَارِبَ وَأَرْخُوا اللِّحَى، خَالِفُوا الْمَجُوسَ
“তোমরা মোচ কাট ও দাড়ি ঝুলিয়ে দাও- অগ্নি পূজারীদের বিরোধিতা কর।” [আবু হুরায়রা রা.-এর সূত্রে মুসলিম ১/১২৯]

লক্ষণীয়: উপরের হাদিসগুলোতে চারটি শব্দ পাওয়া গেল :
وَفِّرُو- ﺃﻭﻓﻮﺍ – اعفُوا- أَرْخُوا

ইমাম নওবি রহঃ বলেন, “এ সকল শব্দের মর্মার্থ একই। তা হল, যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় ছেড়ে দেয়া

❑ বিজ্ঞ আলেমদের অভিমত:

✪ ইবনে হাযম রহ. বলেন,
اتفق الفقهاء على أن حَلْق جميع اللحية مُثْلَة ، ٌلا تجوز” (مراتب الإجماع لابن جزم صـ 252)
“ফকিহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, পুরো দাড়ি মুণ্ডণ করা ‘মুসলা’ যা নাজায়েজ।” [মারাতিবুল ইজমা, পৃষ্ঠা ২৫২]

✪ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন,
“يحرمُ حَلْق اللحية” (الفتاوى الكبرى جـ 5 صـ 302)
“দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম।” (আল ফাতাওয়া আল কুবরা ৫/৩০২)

✪ হানাফি মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম যাইনুল আবেদিন রহঃ বলেন,
“يحرم على الرجل قطع لحيته.” (حاشية ابن عابدين على رد المحتارجـ5 صـ261)
“পুরুষের জন্য দাড়ি কর্তন করা করা হারাম।” [হাশিয়ায়ে আবেদিন আলা রাদ্দিল মুহতার ৫/২৬১

✪ ইবনুল কাইয়েম রহ. বলেন,
شعرُ اللحية فيه منافع: منها: الزينة والوقار والهيبة, ولهذا لا يُرى على الصبيان والنساء من الهيبة والوقار ما يُرى على ذوي اللحى, ومنها التميز بين الرجال والنساء. (التبيان في أقسام القرآن لابن القيم صـ 315)
“দাড়ি রাখার বেশ কিছু উপকারিতা আছে। যেমন: শোভন, ভাবগাম্ভীর্য এবং প্রতিপত্তি। কারণ একজন দাড়ি বিশিষ্ট মানুষের মধ্যে যে ভাবগাম্ভীর্য ও প্রতিপত্তি পরিলক্ষিত হয় নারী ও শিশুদের মধ্যে তা পরিলক্ষিত হয় না। এর আরেকটি উপকারিতা হল, পুরুষ ও নারীর মাঝে পার্থক্য নিরূপণ।” [আত তিবয়ান ফী আকসামিল কুরআন, পৃষ্ঠা ৩১৫]

❑ মুক্তি ও সাফল্যের পথ হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নি:শর্ত অনুসরণ করা এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকা:

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ, সম্মানিত ও সুন্দরতম মানুষ ছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি নিজে দাড়ি রাখতেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে নবীদের পরেই সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ সাহাবায়ে কেরাম। তারাও দাড়ি রাখতেন এবং কাল পরম্পরায় যত বড় বড় ফকিহ, ইমাম, আলেম, মুজতাহিদ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, আল্লাহর ওলি প্রমুখ ছিলেন তারা সকলেই দাড়ি রেখেছেন। তাদের একজনও দাড়ি মুণ্ডণ করেছেন বলে প্রমাণিত হয় নি।

আমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাই তাহলে আমাদের জন্য আবশ্যক হল, নিঃস্বার্থভাবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ করা এবং তার বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে থাকা।

◈ আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّـهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّـهَ كَثِيرًا
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।” (সূরা আহযাব ২১)

◈ তিনি আরও বলেন,

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّـهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّـهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّـهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
“বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মোচন করবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।” (সূরা আলে ইমরান: ৩১)

◈ তিনি আরও বলেন,

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّـهَ
“রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” (সূরা আল হাশর: ৭)

❑ একটি প্রশ্নের উত্তর: অনেকেই বলে থাকে যে, দাড়ি রাখা ফরজ নয় বরং সুন্নত। এ কথা কি সঠিক?

উত্তর:
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাড়ি রেখেছেন সে অর্থে এটি সুন্নত বা অনুকরণীয় আদর্শ। কিন্তু তা পালনের বাধ্য-বাধকতার ক্ষেত্রে বিধানগত ভাবে এটি ফরজ/ওয়াজিব। অর্থাৎ কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে তা পরিত্যাগ করলে গুনাহগার হবে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন বিষয়ে আদেশ করেন তখন তা বাস্তবায়ন করা উম্মতের জন্য ফরজ হয়ে যায়। অনুরূপভাবে যখন তিনি কোন নিষেধ করেন তখন তা করা উম্মতের জন্য হারাম হয়ে যায় যতক্ষণ না সে বিষয়ে অনুমতি বা ছাড় সূচক ভিন্ন কোনও নির্দেশ থাকে।

তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদিসে দাড়ি রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, একাধিক হাদিসে দাড়ি কাটতে নিষেধ করেছেন এবং এর বিপরীতে অন্য কোনও নির্দেশনা তার পক্ষ থেকে পাওয়া যায় নি। সুতরাং এটি অবশ্যই ফরজ। (অবশ্য এক মুষ্টির পরে দাড়ি কাটা যাবে কিনা সে বিষয়টি দ্বিমত পূর্ণ, আমরা এখন সে বিষয়ে আলোচনা করছি না।)

এভাবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম যত আমল করেছেন বা করতে নির্দেশ দিয়েছেন সবই উম্মতের জন্য সুন্নত বা অনুকরণীয় আদর্শ (তার জন্য খাস বিধানগুলো ছাড়া)। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে বিধানগতভাবে কিছু আছে ফরজ বা ওয়াজিব আর কিছু মোস্তাহাব বা নফল। সবগুলোর বিধান এক নয়। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বের দিক দিয়ে তারতম্য আছে।

সুতরাং কথিত ফ্যাশন, স্মার্টনেস প্রমাণ, বন্ধু-বান্ধব ও সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলা, স্ত্রীকে খুশি করা, সমাজের কটু কথা ও বাঁকা দৃষ্টি থেকে বাঁচা ইত্যাদি কারণে দাড়ি কাটা, ছাটা বা মুণ্ডন করা নাজায়েজ বা হারাম।

আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান দীন বিমুখ সমাজে দীন নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে সকল ভ্রুকুটি ও ঝড়ঝঞ্জা উপেক্ষা করে দৃঢ়ভাবে দীনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্যথায় এই সমাজ আমাদেরকে দীন থেকে দূরে সরিয়ে জাহান্নামের ভয়াবহ অগ্নিগর্ভে নিক্ষেপ করবে। আল্লাহ হেফাজত করুন। আমীন।
▬▬▬▬◢◯◣▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।