ইমাম মাহদির আগমনের পূর্বে কোন এক রমজান মাসের মাঝামাঝিতে আকাশ থেকে বিকট আওয়াজ আসা তারপর সত্তর হাজার মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, সত্তর হাজার মানুষ বধির হয়ে যাওয়ার হাদিস অত্যন্ত দুর্বল মতান্তরে বানোয়াট ও বাতিল

সাবধান!
ইমাম মাহদির আগমনের পূর্বে কোন এক রমজান মাসের মাঝামাঝিতে আকাশ থেকে বিকট আওয়াজ আসা তারপর সত্তর হাজার মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, সত্তর হাজার মানুষ বধির হয়ে যাওয়ার হাদিস অত্যন্ত দুর্বল মতান্তরে বানোয়াট ও বাতিল
▬▬▬▬▬●●●▬▬▬▬▬
প্রশ্ন: শোনা যাচ্ছে, ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের পূর্বে রমজান মাসে কয়েকটি নিদর্শন প্রকাশিত হবে। তার মধ্যে রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুক্রবার রাতে আকাশে বিকট শব্দে আওয়াজ হওয়া একটি নিদর্শন। হাদিসটি হল: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কিয়ামতের আগে কোনও এক রমজান মাসে আকাশে বিকট শব্দ হবে। এতে অনেক মানুষ বোবা, বধির ও অজ্ঞান হয়ে যাবে।” এ হাদিসটি কি সহিহ?

উত্তর:
খুবই দুর্ভাগ্য জনক যে, বর্তমানে কিছু কথাকথিত বক্তা বা আলেম ইমাম মাহদী সম্পর্কে বহু জাল, জঈফ এবং বিভিন্ন অতিরঞ্জন মূলক বক্তব্য দিয়ে মানুষের মাঝে নানা বিভ্রান্তি ও ভয়ভীতি সঞ্চার করে চলেছে। এ সব শুনে অনেক মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, কিয়ামতের পূর্বে ইমাম মাহদি আসবেন এবং ন্যায়-নীতি দ্বারা বিশ্ব শাসন করবেন, তখন পৃথিবী ব্যাপী শান্তি ও সমৃদ্ধি ছড়িয়ে পড়বে.. এ সম্পর্কে বহু হাদিস আছে। সেগুলো আমাদের জন্য যথেষ্ট।
তাই বলে, অতি উৎসাহী হয়ে, ইমাম মাহদি বিষয়ে বানোয়াট ও জাল-জঈফ হাদিস বর্ণনা, তার আগমনের সম্ভাব্য সন নির্ধারণ, তাকে স্বপ্নে দর্শন অত:পর তা মাহফিলে-মাহফিলে বলে বেড়ানো, “ইতোমধ্যে তিনি এসে গেছেন, তাঁর জন্ম হয়ে গেছে, উমুক দেশে এক ব্যক্তির মাঝে এত পারসেন্ট আলামত মিলে গেছে” এসব গালগল্প, মিথ্যাচার ও অতিরঞ্জন কোনভাবেই কাম্য নয়।
আল্লাহ আমাদেরকে এসব ফিতনা হেফাজত করুন। আমীন।
যাহোক, এবার আসি, প্রশ্নে উল্লেখিত হাদিস সম্পর্কে। ইমাম মাহদির আগমনের আলামত সংক্রান্ত উপরোক্ত হাদিসটি সহিহ নয়। বিজ্ঞ হাদিস বিশারগদণের
দৃষ্টিতে এটি ‘অত্যন্ত দুর্বল’ বাতিল ও ‘বানোয়াট হাদিস হিসেবে চিহ্নিত।

নিম্নে উপরোক্ত মূল হাদিসটির আরবি টেক্সট, তরজমা, উৎস অত:পর এ সম্পর্কে বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের মতামত ও বক্তব্য তুলে ধরা হল:

হাদিসটি নিম্নরূপ:

ফিরোজ দায়লামি বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
يَكُونُ فِي رَمَضَانَ صَوْتٌ , قَالُوا: فِي أَوَّلِهِ أَو فِي وَسَطِهِ أَو فِي آخِرِهِ؟ قَالَ : لا ؛ بَلْ فِي النِّصْفِ مِنْ رَمَضَانَ ، إِذَا كَانَ لَيْلَةُ النِّصْفِ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ ؛ يَكُونُ صَوْتٌ مِنَ السَّمَاءِ يُصْعَقُ لَهُ سَبْعُونَ أَلْفاً ، وَيُخْرَسُ سَبْعُونَ أَلْفاً ، وَيُعْمَى سَبْعُونَ أَلْفاً ، وَيُصِمُّ سَبْعُونَ أَلْفاً . قَالُوا: فَمَنِ السَّالِمُ مِنْ أُمَّتِكَ؟ قَالَ : مَنْ لَزِمَ بَيْتَهُ ، وَتَعَوَّذَ بِالسُّجُودِ ، وَجَهَرَ بِالتَّكْبِيرِ لِلَّهِ . ثُمَّ يَتْبَعُهُ صَوْتٌ آخَرُ . وَالصَّوْتُ الأَوَّلُ صَوْتُ جِبْرِيلَ ، وَالثَّانِي صَوْتُ الشَّيْطَانِ. فَالصَّوْتُ فِي رَمَضَانَ ، وَالمَعْمَعَةُ فِي شَوَّالٍ ، وَتُمَيَّزُ الْقَبَائِلُ فِي ذِي الْقَعْدَةِ ، وَيُغَارُ عَلَى الْحُجَّاجِ فِي ذِي الْحِجَّةِ ، وَفِي الْمُحْرِمِ ، وَمَا الْمُحْرَّمُ؟ أَوَّلُهُ بَلاءٌ عَلَى أُمَّتِي ، وَآخِرُهُ فَرَحٌ لأُمَّتِي ، الرَّاحِلَةُ فِي ذَلِكَ الزَّمَانِ بِقَتَبِهَا يَنْجُو عَلَيْهَا الْمُؤْمِنُ لَهُ مِنْ دَسْكَرَةٍ تَغُلُّ مِائَةَ أَلْفٍ – أخرجه الطبراني في “المعجم الكبير” (18/332/853) ،

“কোন এক রমজানে আওয়াজ আসবে।”
সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে আল্লাহর রাসুল! রমজানের শুরুতে? নাকি মাঝামাঝি সময়ে? নাকি শেষ দিকে’?

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:
“না, বরং রমজানের মাঝামাঝি সময়ে। ঠিক মধ্য রমজানের রাতে। শুক্রবার রাতে আকাশ থেকে একটি শব্দ আসবে। সেই শব্দের প্রচণ্ডতায় সত্তর হাজার মানুষ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবে আর সত্তর হাজার বধির হয়ে যাবে।”

সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসুল! আপনার উম্মতের মধ্যে কারা সেদিন নিরাপদ থাকবে?

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থানরত থাকবে, সিজদায় লুটিয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং উচ্চ শব্দে আল্লাহু আকবর বলবে।
পরে আরও একটি শব্দ আসবে। প্রথম শব্দটি হবে জিবরাইল এর, দ্বিতীয়টি হবে শয়তানের ।
.
(ঘটনার পরম্পরা এরূপ):
– শব্দ আসবে রমজানে।
– ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হবে শাওয়ালে।
– আরবের গোত্রগুলো বিদ্রোহ করবে জুলকা’দা মাসে।
– হাজী লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটবে জিল হজ্জ মাসে।

আর মুহররমের শুরুটা আমার উম্মতের জন্য বিপদ, শেষটা মুক্তি। সেদিন মুসলমান যে বাহনে চড়ে মুক্তি লাভ করবে, সেটি তার কাছে এক লাখ মূল্যের বিনোদন সামগ্রীতে পরিপূর্ণ ঘরের চেয়েও বেশি উত্তম বলে বিবেচিত হবে।”
(আল ‍মুজামুল কাবীল লিত ত্ববারানী)
—————————
◯◯ এ হাদিস সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের মতামত:

◉ শাইখ আলবানী বলেন: হাদিসটি موضوع বা বানোয়াট।
◉ ইবনুল জাওযী তার আল মাউযুআত বা বানোয়াট হাদিস সংকলন গ্রন্থে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। (৩/১৯১)
তিনি বলেন: “هذا حديث لا يصح এ হাদিসটি সহিহ নয়। কারণ এর সনদে আব্দুল ওয়াহাব নামক একজন বর্ণনাকারী আছে, তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ শক্ত আপত্তি করেছেন। যেমন:
○ ক. উকাইলী বলেন: عبد الوهاب ليس بشيء “আব্দুল ওয়াহাব কিছুই নয়।” (এ বাক্যটি দ্বারা বর্ণনাকারীর প্রতি কঠোর সমালোচনা বুঝায়।)
○ খ. ইবনে হিব্বান বলেন: كان يسرق الحديث ؛ لا يحل الاحتجاج به “সে হাদিস চুরি করত। তার বর্ণিত হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করা বৈধ নয়।”
○ গ. দারাকুতনী বলেন: منكر الحديث মুনকারুল হাদিস। এ ছাড়াও সনদে আরও সমস্যা আছে।
(শাইখ আলবানী রহ. এর সিলসিলা যঈফার ৬০৭৮ ও ৬০৭৯ নং হাদিস পর্যালোচনা থেকে সংক্ষেপিত)
◉ ইমাম যাহাবী বলেন: :باطل এ হাদিসটি বাতিল। (তারতীবুল মাউযুআত, ২৭৮)
◉ হাইসামী বলেন, এই হাদিসের বর্ণনা সূত্রে আব্দুল ওহাব ইবনুয যাহহাক নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যে মুহাদ্দিসীনদের দৃষ্টিতে মাতরূক বা পরিত্যাজ্য। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৭/৩১৩)

◯ ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন:
في أحاديث لا تصح في التواريخ المستقبلية
“অগ্রিম তারিখ নির্ধারণ করে বিভিন্ন ঘটনার ঘটার বেশ কিছু হাদিস পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো সহিহ নয়।” সে সব হাদিসের মধ্যে একটি হল:
يكون صوت في رمضان إذا كانت ليلة النصف منه ليلة جمعة ، يصعق له سبعون ألفا ، ويصم سبعون ألفا
“অর্ধ রমজানের জুমার রাতে একটি আওয়াজ হবে। এতে সত্তর হাজার মানুষ বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে….সত্তর হাজার মানুষ বোবা হয়ে যাবে…..।” (আল মানারুল মুনীফ ৯৬ পৃষ্ঠা)

সুতরাং পরিশেষে বলব, আমাদের কর্তব্য, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা এবং মিথ্যা, বানোয়াট বা বিশুদ্ধ সূত্রে অপ্রমানিত হাদিস থেকে সাবধান হওয়া। কেননা বানোয়াট, জাল-জঈফ হাদিস দ্বারা ইসলামের লাভ হয় না বরং ক্ষতি হয়। পরিণতিতে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, যে ব্যক্তি জেনেশুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করে তার পরিণত হয় জাহান্নাম।
আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং হকের পথে অবিচল রাখুন। আমীন।
▬▬▬▬▬●●●▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।