আহলে হাদিস, সালাফি এবং সংগঠন

প্রশ্ন: আহলে হাদিস এবং সালাফি কি ভিন্ন? আহলে হাদিস বা সালাফিদের জন্য ‘দাওয়াতি সংগঠন, সংস্থা বা দল প্রতিষ্ঠা কি ইসলামে নিষিদ্ধ ‘ফিরকাবন্দি’ এর অন্তর্ভূক্ত?
উত্তর:

❖ এক. আহলে হাদিস এবং সালাফি কি ভিন্ন?

আহলে হাদিস বা সালাফির মাঝে কোন পার্থক্য নাই। তারা সকলেই আকিদা-মানহাজ তথা বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, কর্মনীতি ও কর্মপদ্ধতিতে এক ও অভিন্ন। সালাফি যেমন একটি মানহাজের নাম তেমনি আহলে হাদিসও একটি মানহাজের নাম। আর তা হল, কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফুল উম্মাহ তথা সাহাবি ও তাবেঈনদের বুঝ ও ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন-সুন্নাহর নি:শর্ত অনুসরণ করা এবং এর বাইরে অন্য কোন ব্যক্তির রায় (মতামত), ফতোয়া, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদিকে প্রাধান্য না দেয়া। এটি ইসলামের মধ্যে নতুন কোন ফিরকা বা মতবাদের নাম নয়।

এ নীতির অনুসারীরা ভারত উপমহাদেশে ‘আহলে হাদিস’ আর আরব দেশে ‘সালাফি’ নামে পরিচিত। এগুলো শুধু নামের পার্থক্য; আকিদা, মানহাজ ও আদর্শিক ভাবে এতদুভয়ের মাঝে মৌলিক কোন পার্থক্য নাই আল হামদুলিল্লাহ।

❖ দুই. আহলে হাদিস বা সালাফিদের জন্য ‘দাওয়াতি সংগঠন, সংস্থা বা দল প্রতিষ্ঠা কি ইসলামে নিষিদ্ধ ‘ফিরকাবন্দি’ এর অন্তর্ভূক্ত?

আহলে হাদিস বা সালাফি মানহাজের লোকদেরকে নিয়ে সংগঠন করার ব্যাপারে কথা হল, প্রথমে বুঝা জরুরি যে, সংগঠন (organisation) কাকে বলে এবং এর লক্ষ-উদ্দেশ্য কি?

ব্যবস্থাপনার ভাষায়, বিশেষ কোনও লক্ষ্য অর্জনের জন্য যখন কিছু ব্যক্তি একত্রিত হয় এবং ধারাবাহিকভাবে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকে তাকে সংগঠন (organisation) বলে।”
সংগঠনের উদ্দেশ্য হল, সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংঘবদ্ধভাবে কোন লক্ষ-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা। সংগঠনের ফলে অনেক বড় বড় জটিল ও ব্যয়বহুল কাজ খুব সহজে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। কারণ এখানে দক্ষ ও উপযুক্ত জনশক্তির মধ্যে দায়িত্ব বণ্টণ করে দেয়া হয় এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সম্মিলিত শ্রম, দক্ষতা, জ্ঞান-বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, কলাকৌশল, অর্থ ইত্যাদি কাজে লাগানো হয়।

আমাদের অজানা নয় যে, দুনিয়াবি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে (যেমন: মানবিক, স্বাস্থ্য, নারী, শিশু, পরিবেশ, শ্রমিকের স্বার্থ ইত্যাদি) বিশ্বব্যাপী অসংখ্য সংগঠন ও সংস্থা তৎপর রয়েছে। ঠিক একইভাবে দীনের প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যেও বিশ্বময় অসংখ্য সংগঠন কাজ করছে। কিন্তু এই সব সংস্থা ও সংগঠন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। কোথাও প্রয়োজন নাই আবার কোথাও খুবই জরুরি।

যেমন: সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সালাফি আকিদা ও মানহাজের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। তাই সেখানে তাদের আলাদা কোন সালাফি দল গঠন বা সংগঠনের প্রয়োজন নাই। সেখানে পুরো দেশই ইসলামি সরকারের অধীনে সুগঠিত ও পরিচালিত আল হামদুলিল্লাহ।

যদিও সেখানে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানবিক কাজ, সামাজিক উন্নয়ন ও ইসলামের বিভিন্ন খেদমত আঞ্জাম দেয়ার নিমিত্তে সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য জমঈয়ত বা সংঘ বিদ্যমান রয়েছে। যেমন: জমঈয়াহ খাইরিয়া, জমঈয়াতুল বির, জমঈয়াতুস সুন্নাহ, জমঈয়াতুত তাফসীর, জমঈয়াতুল হিলালিল আহমার ইত্যাদি।

পক্ষান্তরে আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই এবং আহলে বিদআত, কবর পূজারী, পরিপন্থী ও ইসলামের নামে রাজনৈতিক দলগুলো সবাই সাংগঠনিক ও দলীয় প্লাটফরমে সুগঠিত।

এমন পরিস্থিতিতে আহলে হাদিসরা সুগঠিত না থাকলে বা বিচ্ছিন্নভাবে চললে বাতিলদের পক্ষ থেকে নানা আক্রমণ এবং মারাত্মক বিপদাপদে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মূলত: নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ রাখা, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কুরআন-সু্ন্নাহর দাওয়াত প্রচার এবং যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উদ্দেশ্য নিয়েই ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে আহলে হাদিস আলেমগণ শাইখুল ইসলাম আবুল ওয়াফা সানাউল্লাহ আমৃতসরী (১৩৬৭ হি:) এর নেতৃত্বে আহলে হাদিসদের একটি সংগঠন তৈরি করেন। যার নাম ছিল ‘অল ইন্ডিয়া আহলে হাদিস কনফারেন্স।’ (যা পরবর্তীতে ‘জমঈয়তে আহলে হাদিস হিন্দ’ নামে নাম করণ করা হয়)। নি:সন্দেহে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে ভারত উপমহাদেশে আহলে হাদিসগণ দাওয়াতি ময়দানে এক বিরাট শক্তি এবং বিদআত পন্থীদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেব আবির্ভূত হয়।

সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে আহলে হাদিসদেরকে আবারও বিচ্ছিন্ন চলার পরামর্শ দেয়া বা সংগঠন করাকে নিন্দা করার বিষয়টিকে চরম অদূরদর্শিতার পরিচয় বলে মনে করি।
আল হামদুলিল্লাহ আহলে হাদিসদের সংগঠনের অধীনে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সারা দেশে যে পরিমাণ মাদরাসা, মসজিদ, এতিমখানা, লাইব্রেরি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, যে পরিমাণ বই-পুস্তক অনুবাদ, রচনা এবং ম্যাগাজিন ও সাময়িকী ইত্যাদি প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে তা কখনোই সম্ভবপর ছিল না।

❖ একই দেশে একাধিক দাওয়াতি সংগঠন ও দল থাকা কতটা দোষণীয়?

কোন দেশে এক সাথে একাধিক দাওয়াতি সংগঠন ও সংস্থা কাজ করতে পারে যদি তাদের আকিদা-মানহাজ (বিশ্বাস ও কর্মনীতি) এর মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য না থাকে তবে তাদের মাঝে পারস্পারিক সহযোগিতা থাকা আবশ্যক। সেই সাথে এটা ভাবার কোন কারণ নাই যে, ঐ সংগঠনটি একমাত্র ‘হক’ এবং ‘নাজাত প্রাপ্ত’ আর অন্য সব সংগঠন বাতিল ও জাহান্নামী। এটি সম্পূর্ণ শরিয়ত পরিপন্থী ও বাতিল আকিদা।
তবে মনে রাখতে হবে, ইসলামে ফিরকাবন্দি তথা তথা বিদআতের কারণে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে মুসলিমদের বৃহত্তর জামাত থেকে দুরে সরে যাওয়া বা ইসলামি সংঘবদ্ধ জামাতকে বিচ্ছিন্ন করা হারাম এবং জাহান্নামের পথ।

মোটকথা, ‘সংগঠন’ আর ‘ফিরকা’ এর মাঝে পার্থক্য বুঝা জরুরি। ইসলামে ফিরকাবাজি হারাম কিন্তু সংগঠন করা অবশ্যই বৈধ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন,
“والجمعياتُ إذا كثُرت في أيِّ بلدٍ إسلاميٍّ من أجلِ الخيرِ والمساعداتِ والتعاونِ على البرِ والتقوى بينَ المسلمينَ دونَ أن تختلفَ أهواءُ أصحابِها؛ فهي خير وبركة وفوائدها عظيمة، أما إن كانت كل واحدة تضلل الأخرى وتنقد أعمالها؛ فإن الضرر بها حينئذ عظيم، والعواقب وخيمة”.مصدر: مجموع فتاوى ومقالات متنوعة تحت عنوان: “واجب العلماء تجاه الأزمات الكثيرة والنكبات التي حلت بالعالم الإسلامي”.
“কোনও ইসলামি দেশে যদি ভালো কাজ, সাহায্য-সহযোগিতা এবং মুসলিমদের মাঝে সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতির কাজে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে অধিক পরিমাণ জমঈয়ত (সংঘ, সংগঠন) হয় এবং সংগঠনের লোকজন নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ না করে তাহলে এটি কল্যাণকর ও বরকতের কাজ এর উপকারিতা বিশাল। কিন্তু যদি একে অপরকে পথভ্রষ্ট বলে, তাদের কার্যক্রমের দোষ-ত্রুটির সমালোচনায় প্রবৃত্ত হয় তাহলে এগুলোর ক্ষয়-ক্ষতি বিশাল এবং পরিণত খুব খারাপ।” [মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত বিন বায. ৪/১৩৪]
তিনি আরও বলেন,
وفي زمننا هذا -والحمد لله- توجد الجماعات الكثيرة الداعية إلى الحق، كما في الجزيرة العربية: الحكومة السعودية، وفي اليمن والخليج، وفي مصر والشام، وفي أفريقيا وأوربا وأمريكا، وفي الهند وباكستان، وغير ذلك من أنحاء العالم، توجد جماعات كثيرة ومراكز إسلامية وجمعيات إسلامية تدعو إلى الحق وتبشر به، وتحذر من خلافه، فعلى المسلم الطالب للحق في أي مكان؛ أن يبحث عن هذه الجماعات، فإذا وجد جماعة أو مركزاً أو جمعية تدعو إلى كتاب الله عز وجل وسنة رسوله صلى الله عليه وسلم؛ تبِعها ولزمها؛ كأنصار السنة في مصر والسودان، وجمعية أهل الحديث في باكستان والهند، وغيرهم ممن يدعو إلى كتاب الله وسنة رسوله صلى الله عليه وسلم، ويخلص العبادة لله وحده، ولا يدعو معه سواه من أصحاب القبور ولا غيرهم”.
مجموعة فتاوى ومقالات ابن باز ضمن الجواب عن السؤال السادس
“আমাদের যুগে-আল হামদুলিল্লাহ-অনেক হকের দিকে আহ্বানকারী দল আছে যেমন: আলজেরিয়া, সৌদি আরব, ইয়েমেন এবং উপসাগরীয় দেশ সমূহে, মিসর, সিরিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তান ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। অনেক দল, ইসলামি সেন্টার, ইসলামি সংঘ আছে যারা হকের দিকে আহ্বান করে, হকের মিশনারি করে এবং বাতিল ও নাহক বিষয়ে মানুষকে সাবধান করে।
সুতরাং সত্যান্বেষী মুসলিম যেখানেই থাকুক না কেন তার উচিৎ, এসব দল খোঁজা। যদি এমন কোন জামাআত (দল), সেন্টার বা সংগঠন পায় যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর দিকে আহ্বান করে তাহলে সেটিকে আঁকড়ে ধরবে এবং তাদের অনুসরণ করবে। যেমন: মিসর ও সুদানে আনসারুস সুন্নাহ, হিন্দ ও পাকিস্তানে জমঈয়তে আহলে হাদিস ইত্যাদি সংগঠন- যারা আল্লাহর কিতাব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সু্ন্নাহর দিকে আহ্বান জানায়, খালিস ভাবে এক আল্লাহর ইবাদত করে, তাঁকে ছাড়া কবরে শায়িত ব্যক্তি বা অন্য কিছুকে আহ্বান না করে।” [মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত বিন বায. ৬ষ্ঠ প্রশ্নের অন্তর্গত]

মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফদের রেখে যাওয়া আদর্শের উপর সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◈◍◈▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।