আলি রা. কে ঘুমানোর পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কর্তৃক পাঁচটি উপদেশ সংক্রান্ত হাদিসটি বানোয়াট

প্রশ্ন: নিম্নোক্ত বর্ণনাটি সহিহ?
“একদিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলি রা. কে বললেন, “প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ৫টি কাজ করবে। যথা:
১. ৪ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) সদকা করবে।
২. একবার কুরআন খতম করবে।
৩..জান্নাতের মূল্য পরিশোধ করবে।
৪..দু জন ব্যক্তি যদি দু জনের উপর রাগ করে থাকে তাইলে সেই রাগ ভাঙ্গিয়ে তাদেরকে খুশি করে তুলবে।
৫. একবার হজ করবে। তারপর ঘুমাতে যাবে।
আলি রা. তখন বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, এটা তো মনে হচ্ছে অসম্ভব। আমি এই পাঁচটি কাজ কীভাবে করতে পারবো?
তখন নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

১. “সূরা ফাতিহা ৪ বার পড়লেই চার হাজার দিনার সদকা করার সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে।
২. সূরা ইখলাস ৩বার পড়লে একবার কুরআন খতমের সাওয়াব পাবে।
৩. তিনবার যেকোনো একটি দরুদ শরিফ পড়বে, তাহলে জান্নাতের মুল্য পরিশোধ করার সমপরিমাণ সাওয়াব পাওয়া যাবে। (যেমন: সবচেয়ে ছোট দরুদ শরীফ হচ্ছে, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
৪. যেকোনো ইস্তাগফার বা আস্তাগফিরুল্লাহ ১০ বার পাঠ করলে দু জন অখুশি মানুষকে খুশি করার সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে।
৫. সর্বশেষ কালেমা শাহাদত চারবার পাঠ করলে একটি হজ সমপরিমাণ সাওয়াব পাওয়া যাবে।

▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: এই জাতীয় একটা হাদিস (কিছু শব্দের কম-বেশি সহকারে) ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচারিত। তা বিভিন্ন ফজিলতের কিতাবেও পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় দীনের গভীর জ্ঞান নেই এমন কিছু মসজিদের ইমাম, খতিব ও বক্তার মুখেও তা শোনা যায়। এ কথাগুলো আমাদের দেশে রঙ্গিন পোস্টার আকারে বাজারে কিনে পাওয়া যায়। কোনো কোনো বাড়ির দেওয়ালেও তা ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যাচার। অর্থাৎ এটি একটি বানোয়াট হাদিস।

◾সৌদি আরবের ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন:
هذا الحديث لا أصل له ، بل هو من الموضوعات ، من كذب بعض الشيعة كما نبَّه على ذلك أئمَّة الحديث .
” فتاوى اللجنة الدائمة ” ( 4 / 462 ، 463 )

“এই হাদিসটির কোন ভিত্তি নেই। বরং তা কতিপয় শিয়াদের মিথ্যাচার ও বানোয়াট হাদিসগুলোর অন্তর্ভুক্ত। যেমনটি এ ব্যাপারে হাদিসের ইমামগণ সতর্ক করেছেন।” [ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ, ৪/৪৬২ ও ৪৬৩]

◾সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রহ. বলেন,
هذا باطل، مكذوب على الرسول ﷺ قد نبهنا على هذا أكثر من مرة، مكذوب، ولكن هذه الأذكار طيبة، الإنسان يقولها، طيبة يذكر الله، ويقرأ القرآن طيب، لكن هذا مكذوب على الرسول ﷺ الكلام هذا.
“আমরা এ বিষয়ে একাধিকবার সতর্ক করেছি যে, এটি একটি ভ্রান্ত কথা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যাচার। তবে এই সকল জিকির-আজকারগুলো ভালো। মানুষগুলো এসব জিকির পাঠ করবে। জিকির করা ভালো। কুরআন তেলাওয়াত করা ভালো। কিন্তু উপরোক্ত কথাগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যাচার।” [Binbaz]

◾ বর্তমান শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সালেহ আল উসাইমিন রহ. বলেন,
هذا الحديث الذي ذكره أن النبي صلى الله عليه وسلم أوصى علي بن أبي طالب رضي الله عنه بهذه الوصايا : كذب موضوع على النبي صلى الله عليه وسلم ، لا يصح أن يُنسب إلى الرسول صلى الله عليه وسلم
“যে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলিয রা.কে এ সকল উপদেশ দিয়েছেন তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যাচার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম-এর দিকে তা সম্বন্ধ করা ঠিক নয়।” [ফাতাওয়া ইসলামিয়া ৪/১১১]
অথচ বহু হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে জেনে-বুঝে মিথ্যাচার করাকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে সতর্ক করা হয়েছে। [সহিহ বুখারি]
إنَّ كَذِبًا عَلَيَّ ليسَ كَكَذِبٍ علَى أَحَدٍ، مَن كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ

কেউ যদি এই বানোয়াট হাদিস অনুযায়ী আমল করে তাহলে তা বিদআত (দীনের মধ্যে নব আবিষ্কৃত বিষয়) হিসেবে পরিগণিত হবে। আর প্রতিটি বিদআতি আমল প্রত্যাখ্যাত হবে। [সহিহ বুখারী] শুধু তাই নয়, বিদআতি ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারের পানি পান করা‌ থেকে বিতাড়িত করা হবে। [সহিহ বুখারি]

সুতরাং এই সকল ভ্রান্ত, বাতিল ও হাদিসের নামে মিথ্যা কথাবার্তা মুসলিম সমাজে প্রচার করা জায়েজ নেই।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে ধর্মের নামে সব ধরনের ভ্রান্ত, বাতিল এবং বিদআতি কথাবার্তা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।