আমল কবুলের কতিপয় উপায় এবং রমজানের পরে করণীয়

যে কোন সৎ আমল করার পর আমাদের নিকট যে বিষয়টি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তা হল: আমল কবুলের বিষয়; কবুল হল কি হল না। নিশ্চয়ই সৎ আমল করতে পারা বড় একটি নেয়ামত; কিন্তু অন্য একটি নেয়ামত ব্যতীত তা পূর্ণ হয় না, যা তার চেয়ে বড়। তা হল, কবুলের নিয়ামত। এটি নিশ্চিত যে, রমজানের পর এত কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে তা যদি কবুল না হয় তবে অবশ্যই এক মহা বিপদ। এর চেয়ে আর বড় ক্ষতি কী রয়েছে যদি আমলটি প্রত্যাখ্যাত হয়, আর দুনিয়া আখিরাতের স্পষ্ট ক্ষতিতে প্রত্যাবর্তন করে?

বান্দা যেহেতু জানে, অনেক আমলই রয়েছে যা বিভিন্ন কারণে গ্রহণযোগ্য হয় না। অতএব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমল কবুলের কারণ ও উপায় সম্পর্কে জানা। যদি কারণগুলো তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে এবং ক্রমাগত তার উপর অটল থাকে ও আমল করে যায়। আর যদি তা বিদ্যমান না পায় তবে এ মুহূর্তেই যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হল, ইখলাসের সাথে সেগুলোর মাধ্যমে আমল করায় সচেষ্ট হওয়া।

❒ আমল কবুলের কতিপয় উপায়:

১. স্বীয় আমলকে বড় মনে না করা ও তার উপর গর্ব না করা:
মানুষ যত আমলই করুক না কেন, আল্লাহ তার দেহ থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে যত নেয়ামত তাকে প্রদান করেছেন, সে তুলনায় আল্লাহর সে মূলত: কিছুই হক আদায় করতে পারেনি।
সুতরাং একনিষ্ঠ ও খাঁটি মুমিনের চরিত্র হল, তারা তাদের আমল সমূহকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে, বড় মনে করে গর্ব-অহংকার করবে না; যার ফলে তাদের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায় ও অলসতা এসে যায় সৎ আমল করার ক্ষেত্রে।

❒ স্বীয় আমলকে তুচ্ছ জ্ঞান করার সহায়ক বিষয়:

(১) আল্লাহ তাআলাকে যথাযথভাবে জানা ও চেনা।
(২) তাঁর নিয়ামত সমূহ উপলব্ধি করা
(৩) ও নিজের গুনাহ-খাতা ও অসম্পূর্ণতাকে স্মরণ করা। যেমন: আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে গুরু দায়িত্ব অর্পণের পরে অসিয়ত করেন:
“(নবুয়তের বোঝা বহন করত:) তুমি (তোমার রবের প্রতি) অনুগ্রহ প্রকাশ কর না যার ফলে বেশি কিছু আশা করবে।” [সূরা মুদ্দাসসির: ৬]
২. আমলটি কবুল হবে কিনা, এ মর্মে আশঙ্কিত থাকা: সালাফে সালেহীন-সাহাবায়ে কিরাম আমল কবুল হওয়ার ব্যাপারটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন। এমনকি তাঁরা ভয় ও আশঙ্কায় থাকতেন। যেমন: আল্লাহ তাঁদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, “যারা ভীত-কম্পিত হয়ে দান করে যা দান করার।‌কেননা তারা তাদের রবের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে।” [মুমিনুন: ৬০]

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আয়াতের ব্যাখ্যা করেন যে, “তারা রোজা রাখে, নামাজ আদায় করে, দান-খয়রাত করে আর ভয় করে যে, মনে হয় তা কবুল হয় না।” আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “তোমাদের পক্ষ হতে তোমাদের আমল সমূহ কবুল হওয়ার ব্যাপারে তোমরা খুব বেশি গুরুত্ব প্রদান কর। তোমরা কি আল্লাহর বাণী শ্রবণ কর না। “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের পক্ষ হতেই কবুল করে থাকেন।” [সূরা: মায়েদা: ২৭]

৩. আমল কবুলের আশা পোষণ ও দুআ করা:
আল্লাহর প্রতি ভয়ই যথেষ্ট নয়।‌বরং অনুরূপ তাঁর নিকট আশা পোষণ করতে হবে। কেননা আশা বিহীন ভয় নিরাশ হওয়ার কারণ এবং ভয় বিহীন আশা আল্লাহর শাস্তি হতে নিজেকে মুক্ত মনে করার কারণ।‌অথচ উভয়টিই দোষনীয়, যা মানুষের আকিদা ও আমলে মন্দ প্রভাব বিস্তার করে।

জেনে রাখুন! আমল প্রত্যাখ্যান হয়ে যাওয়ার ভয়-আশঙ্কার সাথে সাথে আমল কবুলের আশা পোষণ মানুষের জন্যে বিনয়-নম্রতা ও আল্লাহ ভীতি এনে দেয়। যার ফলে তার ঈমান বৃদ্ধি পায়। যখন বান্দার মধ্যে আশা পোষণের গুণ সাব্যস্ত হয় তখন সে অবশ্যই তার আমল কবুল হওয়ার জন্য তার প্রভুর নিকট দু হাত তুলে প্রার্থনা করে। যেমন করেছিলেন আমাদের পিতা ইবরাহিম খলিল ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আলাইহিমাস সালাম)। যা আল্লাহ তাআলা তাদের কাবা গৃহ নির্মাণের ব্যাপারটি উল্লেখ করে বর্ণনা করেন।

“যখন ইবরাহিম ও ইসমাইল (আলাইহিমাস সালাম) বায়তুল্লাহর ভিত্তি বুলন্দ করেন (দুআ করেন): “হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক তুমি আমাদের দুআ কবুল করেনিও।নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।” [সূরা বাকারা: ১২]

৪. বেশি বেশি ইস্তেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা করা:
মানুষ তার আমলকে যতই পরিপূর্ণ করার জন্য সচেষ্ট হোক না কেন, তাতে অবশ্যই ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা থেকেই যাবে। এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শিক্ষা দান করেছেন, কিভাবে আমরা সে অসম্পূর্ণতাকে দূর করব।
তাইতো তিনি আমাদেরকে ইবাদত-আমলের পর ইস্তেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনার শিক্ষা দান করেন। যেমন: আল্লাহ তাআলা হজের হুকুম বর্ণনার পর বলেন, “অত:পর তোমরা (আরাফাত) হতে প্রত্যাবর্তন করে, এসো যেখান থেকে লোকেরা প্রত্যাবর্তন করে আসে। আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাক,নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা ক্ষমাশীল ও দয়াবান।” [সূরা বাকারা: ১৯৯] আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক নামাজের পর তিন বার করে “আস্তাগফিরুল্লাহ” (আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি) বলতেন।

৫. বেশি বেশি সৎ আমল করা:নিশ্চয়ই সৎ আমল একটি উত্তম বৃক্ষ। বৃক্ষের প্রয়োজন পরিচর্যা, যেন তা বড় এবং শক্ত হয়ে ওঠে এবং ফল দিতে পারে। সৎ আমলের পর সৎ আমল করে যাওয়া অবশ্যই আমল কবুলের একটি অন্যতম আলামত। আর এটি আল্লাহর বড় অনুগ্রহ ও নেয়ামত, যা তিনি তার বান্দাকে প্রদান করে থাকেন। যদি বান্দা উত্তম আমল করে ও তাতে ইখলাস বজায় রাখে তখন আল্লাহ তার জন্য অন্যান্য উত্তম আমলের দরজা খুলে দেন। যার ফলে তার নৈকট্যের ও বৃদ্ধি পায়।
৬. সৎ আমলের উপর অবিচল থাকা এবং এতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা:

যে ব্যক্তি নেকি অর্জনের মৌসুম অতিবাহিত করার পর সৎআমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায়, তার জন্য জরুরি হল, সে যেন সৎ আমলের ওর অবিচল থাকার গুরুত্ব, ফজিলত, উপকারিতা, তার প্রভাব, তা অর্জনের সহায়ক বিষয়ে সালাফে-সালেহীনের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে।

– সৎ আমলের উপর অবিচল থাকার গুরুত্ব:

ইসলামি শরিয়তে সৎ আমলের উপর অবিচল থাকার গুরুত্ব নিন্মের বিষয়গুলো হতে ফুটে ওঠে:

১. আল্লাহ তাআলার ফরজ সমূহ। যা অবশ্যই ধারাবাহিতকতার ভিত্তিতেই ফরজ করা হয়েছে এবং তা আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল।
২. সৎ আমলের স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অন্যতম তরিকা ও নীতি।
৩. ক্রমাগত আমল ও তার ধারাবাহিকতা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিকট উত্তম আমলের অন্তর্ভুক্ত। রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল হল, যা নিয়মিতৎভাবে করে যাওয়া হয়, যদিও তা অল্প হয়।” [বুখারী-মুসলিম]

– সৎ আমলের উপর অবিচল থাকার প্রভাব ও উপকারিতা:

আল্লাহ তাআলা তাঁর সৎ আমলের হেফাজত কারী বান্দাদেরকে বহুভাবে সম্মানিত ও উপকৃত করে থাকেন। যেমন:
১. স্রষ্টার সাথে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ; যা তাকে অগাধ শক্তি, দৃঢ়তা, আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক ও তার উপর বিশাল আস্থা তৈরি করে দেয়। এমনকি তার দুঃখ-কষ্ট ও চিন্তা-ভাবনায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করবে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।” [সূরা তালাক: ৩ ]

২. অলসতা-উদাসীনতা হতে অন্তরকে ফিরিয়ে রেখে সৎ আমলকে আঁকড়ে ধরার প্রতি অভ্যস্ত করা যেন ক্রমান্বয়ে তা সহজ হয়ে যায়। যেমন কথিত রয়েছে: “তুমি তোমার অন্তরকে যদি সৎআমলে পরিচালিত না কর, তবে সে তোমাকে গুনাহর দিকে পরিচালিত করবে।”

৩. এ নীতি অবলম্বন হল, আল্লাহর মোহব্বত ও অভিভাবকত্ব লাভের উপায়। যেমন হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, “আমার বান্দা নফল ইবাদতসমূহ দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতেই থাকে, এমনকি তাকে আমি মহব্বত করতে শুরু করি।” (বুখারী)

৪. সৎআমলে অবিচল থাকা বিপদ-আপদে মুক্তির একটি কারণ। যেমন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কে উপদেশ দেন: “আল্লাহকে হেফাজত কর (অর্থাৎ তার হুকুম-আহকামগুলো পালন কর) তবে তিনিও তোমাকে হেফাজত করবেন, আল্লাহকে হেফাজত কর তবে তুমি তাঁকে তোমার সামনে পাবে। সুখ ও সচ্ছল অবস্থায় তাঁকে চেন তাহলে তিনি তোমাকে বিপদে চিনবেন।” [মুসনাদে আহমদ]

৫. সৎ আমলে অবিচলতা অশ্লীলতা ও মন্দ আমল হতে বিরত রাখে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখে।” [সূরা আনকাবূত: ৪৫]

৬. সৎ আমলে অবিচল থাকা গুনাহ-খাতা মিটে যাওয়ার একটি মাধ্যম। যেমন: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: “তোমাদের কারো দরজায় যদি একটি নদি থাকে, আর সে তাতে প্রতিদিন পাঁচবার করে গোসল করে, তবে তার দেহে কি কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে? সাহাবিগণ বলেন, না। তখন তিনি বলেন, ঠিক এমনই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।‌ আল্লাহ যার দ্বারা গুনাহ সমূহকে মিটিয়ে দেন।” (বুখারী-মুসলিম)

৭. সৎ আমলে অবিচল থাকা, শেষ পরিণাম ভাল হওয়ার মাধ্যম। যেমন: আল্লাহ বলেন,
“যারা আমার পথে চেষ্টা-সাধনা করবে অবশ্যই আমি তাদেরকে আমার পথ দেখিয়ে দিব,নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎ‌ আমল কারীগণের সাথে আছেন।” [সূরা আনকাবূত: ৬৯]

৮. এটি কিয়ামতের দিন হিসাব সহজ হওয়া ও আল্লাহর ক্ষমা লাভের অন্যতম উপায়।

৯. এ নীতি মুনাফেকি হতে অন্তরের পরিশুদ্ধতা ও জাহান্নামের আগুন হতে পরিত্রাণের একটি উপায়।
যেমন: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন (ক্রমাগত) জামায়াতের সাথে প্রথম তাকবির পেয়ে নামাজ আদায় করবে তার জন্য রয়েছে দু প্রকার মুক্তির ঘোষণা:
(১) জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি ও
(২) মুনাফেকি হতে মুক্তি। [তিরমিযী-হাসান]

১০. এটি জান্নাতে প্রবেশের উপায়:

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন জিনিসের দু প্রকার আল্লাহর রাস্তায় খরচ করল, তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ হতে আহ্বান করা হবে। জান্নাতের রয়েছে আটটি দরজা। সুতরাং যে ব্যক্তি নামাজি তাকে নামাজের দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে, যে ব্যক্তি জিহাদ কারী তাকে জিহাদের দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে, যে ব্যক্তির দান কারী তাকে দানের দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে এবং যে ব্যক্তি রোজাদার তাকে রাইয়ান নামক দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে।” [বুখারী-মুসলিম]

১১. যে ব্যক্তি নিয়মিত সৎ আমল করে অতঃপর অসুস্থতা, সফর বা অনিচ্ছাকৃত ঘুমের কারণে যদি সে আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে তার জন্য উক্ত আমলের সওয়াব লিখা হবে। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “বান্দা যখন অসুস্থ হয় বা সফর করে, তবে তার জন্য অনুরূপ সওয়াব লিখা হয় যা সে গৃহে অবস্থানরত অবস্থায় ও সুস্থ অবস্থায় করত।” [সহিহ বুখারি]

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তির রাতে নামাজ ছিল কিন্তু ঘুমের কারণে তা আদায় করতে পারল না আল্লাহ তার জন্য সে নামাজের সওয়াব লিখে দিবেন এবং তার তার ঘুম হবে তার জন্য সদকা স্বরূপ। [নাসায়ী ও মুয়াত্তা মালিক-সহীহ]

❒ রমজানের পর করণীয়:

মাহে রমজান হতে আমরা কী উপকারিতা লাভ করলাম? আমরা তো কোরআনের মাস কে বিদায় জানালাম। অমরা অতিবাহিত করলাম তাকওয়ার মাস। আমরা বিদায় জানালাম ধৈর্যের মাস। যাতে আমরা আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ ও পাপাচার হতে বিরত থাকার মাধ্যমে ধৈর্যের অনুশীলন করেছি। আমরা অতিবাহিত করলাম জিহাদের মাস। ২য় হিজরির এ মাসেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, হক ও বাতিলের পার্থক্য নিরূপণ কারী ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। আমরা অতিবাহিত করলাম রহমতের মাস, বরকতের মাস, মাগফিরাতের মাস ও জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তির মাস (উল্লেখ্য উক্ত বিষয়গুলো একমাত্র রমজানের জন্যই নির্ধারিত নয় বরং সব সময়ের জন্য। তবে এ মাসে এ গুলোর গুরুত্ব ও ফজিলত বেশি)।

যেহেতু আমরা রমজানের প্রতিষ্ঠান হতে মুত্তাকির সনদ নিয়ে বের হলাম, তবে কি আমরা যথাযথ তাকওয়া অর্জন করতে পেরেছি?

আমরা কি আত্মা ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদে বিজয় লাভ করতে পেরেছি? না অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার, বদভ্যাস, যত অনৈসলামি কৃষ্টি-কালচার আমাদের মাঝে ছেয়ে বসেছ?

আমরা কি রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও মুক্তি পাওয়ার মাধ্যমগুলোর অনুশীলন করেছি? বহু জিজ্ঞাসা…এর উত্তর নিজেই তালাশ করি।
রমজান হল ঈমান বৃদ্ধির এক মহাবিদ্যালয়। এটি অবশিষ্ট বছরের আত্মিক পাথেয় সংগ্রহের এক মহাকেন্দ্র। সুতরাং যে এই রমজান হতে উপদেশ ও উপকার গ্রহণ করতে পারল না এবং স্বীয় জীবনকে পরিবর্তন করতে পারল না তবে কখন?

আসুন, আমরা এই মহাবিদ্যালয় হতে আমাদের আমল, আখলাক চরিত্র, অভ্যাস ও ব্যবহারকে ইসলামি শরিয়ত সম্মত করি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ اللّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ

“আল্লাহ কোন জাতির অবস্থান পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদেরনিজেদের অবস্থাননিজে পরিবর্তন না করে।” (আর রাদ: ১১)

❒ রমজান কেন্দ্রিক মানুষের প্রকারভেদ:

১. রমজানের পূর্বেও তারা আল্লাহর অনুগত হয়ে ইবাদত-বন্দেগি করত। রমজান মাসের আগমনে এর ফজিলত ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে তারা আরও তৎপর হয়। তাঁদের প্রতি আমাদের আহ্বান তাঁরা যেন রমজানের পরেও আল্লাহর আনুগত্য ও অনুসরণে এবং ইবাদত- বন্দেগিতে সদা অটল থাকেন।

২. রমজানের পূর্বে তারা ছিল গাফেল-উদাসীন। রমজান মাসের আগমনে এর ফজিলত ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে তারা তৎপর হয়। এদেরকে আমরা আহ্বান জনাই , তারা যেন রমজানের পর ইবাদত-বন্দেগি হতে পুনরায় গাফেল না হয়ে আজীবন ইবাদতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

৩. রমজান আগমন করল ও বিদায় হয়ে গেল তাদের কোন উপলব্ধি ও পরিবর্তন ঘটল না। তাদেরকে আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাই, আল্লাহরনিকট তওবা করতে ও তাঁর আনুগত্যের পথে ফিরে আসতে।

প্রিয় পাঠক, আপনি যদি রমজান হতে যারা উপকৃত তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুত্তাকি-পরেহেযগারদের গুণে গুণান্বিত হন এবং যথাযথ রোজা পালন করে থাকেন। প্রকৃত ভাবেই ইবাদত-বন্দেগি করে থাকেন এবং কু প্রবৃত্তিকে যথাযথ দমন করে থাকেন তবে আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন এবং তার উপর মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য আল্লাহরনিকট প্রার্থনা করুন।
পক্ষান্তরে আপনাকে সতর্ক থাকার আহবান জানাই, আপনি ঐ ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হবেন না যেমন এক বুড়ি উত্তমরূপে চরকায় সূতা, কেটে সুন্দর একটি পোশাক তৈরি করল যার ফলে সবাই তার প্রশংসা করল ও মুগ্ধ হল এবং সেনিজেও আনন্দিত হল। হঠাৎ করে একদিন অকারণেই উক্ত পোশাকটি একটি একটি করে সুতা খুলে নষ্ট করে ফেলল। অতএব মানুষ তাকে কি বলতে পারে?

ঠিক অনুরূপ ঐ ব্যক্তির অবস্থা যে রমজানোত্তর পুনরায় পাপাচার ও অন্যায়ে ফিরে আসে এবং সৎ আমল পরিত্যাগ করে এরা কতইনানিকৃষ্ট যারা আল্লাহকে শুধুমাত্র রমজানেই স্মরণ করে।

এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلاَ تَكُونُواْ كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِن بَعْدِ قُوَّةٍ أَنكَاثًا
” তোমরা সেই নারীর মত হয়ো না , যে তার সূতা মজবুত করে পাকাবার পর তার পাক খুলে নষ্ট করে দেয়।” (সূরা নাহাল: ৯২)

❒ রমজানের পর অঙ্গিকার ভঙ্গ করে পাপাচারে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ:

রমজান মাসে সৎ আমলের যথাযথ অনুশীলন করা সত্ত্বেও কৃত অঙ্গিকার ভঙ্গ করার বহু লক্ষণ রয়েছে দৃষ্টান্ত স্বরূপ:

(১) ঈদের দিনই জামাতের সাথে নামাজ আদায় না করা বা পূর্ণ পাঁচ ওয়াক্ত আদায় না করা।
(২) ঈদের খুশির নামে গান বাজনা, ছায়াছবি, ডিশ ও ভিডিও তে অবৈধ অনুষ্ঠানমালা দর্শনে মেতে ওঠা এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার চর্চা।
(৩) ঈদ উপলক্ষে বেপর্দা ও অবাধে নারীদের বিচরণ করা এবং পার্ক, বিভিন্ন অনুষ্ঠান কেন্দ্র ও খেল-তামাশার স্থানে নারী-পুরুষের অবাধ সংমিশ্রণ।

তবে এ গুলোই কি রমজানের আমলগুলো কবুলের আলামত? না বরং এ সব হচ্ছে তার আমল কবুল না হওয়ার আলামত। কেননা প্রকৃত রোজাদার ঈদের দিন আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আদায় করে। খুশি হবে যে সে দীর্ঘ একমাস আল্লাহর হুকুম পালন করে আজ অনেক কিছু হতে মুক্ত। এবং সাথে সাথে সে ভয়ে ভিত থাকবে যে আল্লাহ আমার আমল নাও কবুল করতে পারেন। এ জন্য সে তাঁরনিকট প্রার্থনা করবে যাতে উক্ত আমল কবুল হয়। যেমন আমাদের মহান উত্তর সূরীগণ ছয়মাস পর্যন্ত রমজানের আমলগুলো কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহরনিকট প্রার্থনা করতেন।
সুতরাং রমজানের আমল কবুলের আলামত হল, বান্দানিজেকে তার পূর্বের অবস্থার চেয়ে উত্তমাবস্থায় পৌঁছাবে এবং সৎ কর্মে পূর্বের চেয়ে অগ্রগামী হবে। অতএব আমরা শুধু মৌসুম ভিত্তিক এবাদত করেই বিরত থাকব না বরং আমরা সব সময়ের জন্য এবাদত জারি রাখব। কেননা আল্লাহ বলেন,

وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ

” তুমি মৃত্যু অবধি তোমার রবের এবাদত করতে থাক।” (সুরা হিজর: ৯৯)

❒ রমজানের পর আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষা:

রমজান অতিবাহিত হয়ে গেলেও মুমিনদের জন্য মৃত্যু পর্যন্ত আমলের ধারাবাহিকতা ছিন্ন হবে না:

✪ প্রথমত: রমজানের রোজা শেষ হলেও অবশিষ্ট মাসগুলোতে বহু নফল রোজা রয়েছে। যেমন:

(১) শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা রাখার পর শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা মিলিয়ে নিলো তার পুরা বছরের রোজা রাখার সমতুল্য হল।” (মুসলিম)

কেননা সাওবান (রা.) হতে মারফু হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, রমজান মাসের রোজা দশ মাসের তুল্য আর শাওয়ালের ছয় দিনের রোজা দুই মাসের সমান। এভাবেই পূর্ণ বছরের রোজা। [ইবনে খুজাইমা ও ইবনে হিব্বান আর ইবনে জারুল্লাহর রিসালায়ে রমজান হতে গৃহীত]

আর প্রত্যেক আমলের নেকি দশগুণ বৃদ্ধি পায়। অতএব রমজান মাসের রোজা তিন শত দিনের সমান এবং শাওয়ালের ছয়টি রোজা ৬০দিনের সমান। অতএব সর্বমোট ৩৬০দিন আর হিজরি বছর হয় ৩৬০ দিনে।

(২) প্রতি চন্দ্র মাসের তিন দিন রোজা রাখা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “প্রতি মাসের তিন দিন এবং এক রমজান হতে অন্য রমজানের রোজা পূর্ণ বছর রোজা রাখার সমতুল্য। (মুসলিম) আর এ রোজা প্রতিমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রাখা উত্তম যা অন্য হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত।

(৩) প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও সোমবার রোজা রাখা: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, সোম ও বৃহস্পতিবার আমলনামা আল্লাহরনিকট পেশ হয়। সুতরাং আমি পছন্দ করি যে, আমার আমল পেশ হচ্ছে এমতাবস্থায় আমি রোজা আছি।”(তিরমিযী: ৭৪৭, তিনি হাদিসটি হাসান বলেছেন)

(৪) আরাফা দিনের রোজা: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম))কে আরাফা দিনের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “এই রোজা বিগত বছর ও আগামী বছরের (ছোট গুনাহের) কাফফারা হয়।” (মুসলিম)।

(৫) আশুরার রোজা: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আশুরার রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “বিগত বছরের (ছোট) গুনাহের কাফফারা।” (মুসলিম)

(৬) শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখা: শবে বরাত ধারণা করে ১৫ই শাবানকে নির্ধারণ না করে এ মাসে বেশি বেশি রোজা রাখা যায়। কেননা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমজানের পর এ মাসেই বেশি রোজা রাখতেন। ১৫ই শাবান খাস করেননি।

✪ দ্বিতীয়ত: রমজানের তারাবির নামাজ শেষ, তবে এই নামাজ তথা কিয়ামুল লাইল তাহাজ্জুদ হিসেবে সারা বছর পড়া যায়। নবী (সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ফরজ ব্যতীত সর্বোত্তম নামাজ হল রাত্রির নামাজ- তাহাজ্জুদ। (মুসলিম)

✪ তৃতীয়ত: ফরজ নামাজ সংশ্লিষ্ট ১২ রাকাত সুন্নতে মুয়াকাদা আদায়: জহরের পূর্বে চার রাকাত পরে দুই রাকাত, মাগরিবের পর দুই রাকাত, এশার পর দুই রাকাত এবং ফজরের পূর্বের দুই রাকাত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলই হি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি ফরজ ছাড়াও ১২ রাকাত দিবা রাত্রিতে সুন্নত আদায় করল আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদনির্মাণ করবেন।” (মুসলিম)

✪ চতুর্থত: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইরশাদ কৃত নামাজের পরে ও সকাল সন্ধ্যার দোয়া জিকির।

✪ পঞ্চমত: সাদাকাতুল ফিতর শেষ হলেও সারা বছর সাধারণ দান-সদাকা করা যায়।

✪ ষষ্ঠত: কুরআন তেলাওয়াতের ফজিলত সব সময়ের জন্য; শুধু রমজানের জন্য নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যারা কুরআন হতে একটি অক্ষর পড়ল তার জন্য একটি নেকি, আর একটি নেকি দশগুণে বর্ধিত হয়। আমি বলি না যে “আলিফ লাম মিম” মাত্র একটি অক্ষর বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, ও মিম একটি অক্ষর।” [তিরমিযী:২৯১০, তিনি হাদিসটি সহীহ হাসান বলেছেন] তিনি আরও বলেছেন: “তোমরা কুরআন পাঠকর, কেননা তা কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্য শাফায়াত কারী হিসেবে আসবে।” (মুসলিম)

সম্মানিত পাঠক, এ ভাবে সব সময়ের জন্য সৎ আমলের দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে। অতএব আপনি যথাযথ প্রচেষ্টা জারি রাখুন, অলসতা বর্জন করুন। যদিও নফল সুন্নতে আপনার দূর্বলতা থাকে কিন্তু কোন ক্রমেই যেন ফরজ আদায়ে ত্রুটি না হয়। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা ইত্যাদি।
পরিশেষে, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে সহীহ আকিদাও সৎ আমলের উপর সুদৃঢ় রাখেন এবং এমতাবস্থায় মৃত্যু দান করেন। আমিন।

লেখক: মুহাম্মাদ আব্দুর রব আফ্ফান
সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।