আইন বিষয়ে পড়াশোনা করা এবং আইনজীবী ও বিচারক হিসেবে কাজ করার বিধান

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করা এবং আইনজীবী ও বিচারক হিসেবে কাজ করার বিধান

নিম্নে এ বিষয়ে ৪টি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হল: وبالله التوفيق

❑ ১. আইন বিষয়ে পড়াশোনা এবং বিচার কিংবা ওকালতি পেশায় চাকরি করার বিধান

প্রশ্ন: আমরা জানি, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় ইসলামি শরিয়ত পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয় না বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানব রচিত আইন-কানুন প্রচলিত রয়েছে। এমতবস্থায় ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়াশোনা করা, অত:পর এডভোকেট, উকিল এবং বিচারক-এর পেশায় যাওয়া কি জায়েজ হবে?
উত্তর: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। স্বভাবতই ইসলামে সমাজে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ, জুলুম-নির্যাতন, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, মতবিরোধ, অধিকার হরণ, দাবি-দাওয়া ইত্যাদি নিষ্পত্তির ব্যাপারে সুস্পষ্ট আইন-কানুন রয়েছে।
সুতরাং মুসলিম সরকারের জন্য ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ও বিচারকার্য পরিচালনা করা ফরজ এবং ইসলামি আইনের বিপরীতে মানব রচিত আইন দ্বারা বিচার পরিচালনা করা হারাম। আল্লাহ তাআলা কুরআনে একাধিক স্থানে আল্লাহর আইন ব্যতিরেকে মানব রচিত আইন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা কারীদেরকে কাফের, ফাসেক এবং জালিম হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহর আইন ও বিধান ব্যতিরেকে বিচার-ফয়সালা করা কখনও কুফরি পর্যায়ের অপরাধ, আবার কখনো কবিরা গুনাহ (ফাসেকি ও জুলুম)। দেখুন: সূরা মায়িদা-এর ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা।

সঙ্গত কারণেই ইসলামি আইন-কানুন সম্পর্কে পড়াশোনা করা অপরিহার্য (ফরজে কেফায়া)। কেননা কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জন ছাড়া তা বাস্তবে প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও মুসলিম যদি ইসলামি আইনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ এবং তথাকথিত ইসলাম বিরোধী মানব রচিত আইনের অসারতা ও ক্ষতিকারক বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে পড়াশোনা করে তাহলে এতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের এ সকল মানব রচিত আইন দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনা করা, প্র্যাকটিস করা,‌ আইনি সহায়তা দেওয়া বা ওকালতি করা হারাম।

◈ আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রহ. বলেন,

وأما تعلم الإنسان للقوانين الوضعية، إذا كان يتعلمها من أجل أن يدفع الباطل بالحق ؛ فهذا لا بأس به ، وإذا كان يتعلمها من أجل أن يتبع ما فيها من القوانين المخالفة للشرع ؛ فهذا حرام. وفي هذا نقول : حتى المحاماة في بلد تحكم الشريعة فيه نقول: إذا كان المحامي يريد إيصال الحق إلى أهله ؛ فلا بأس أن يمارس هذه المهنة ، وإن كان يريد أن يغلب الناس في قوله ومحاماته بالحق أو بالباطل ؛ فهذا حرام ” انتهى باختصار من “لقاء الباب المفتوح” (33/6).

“আর কেউ যদি মানব রচিত আইন বিষয়ে শিক্ষার্জন করে সত্যে দ্বারা মিথ্যাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তাহলে এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যদি জ্ঞানার্জন করে ততে যে সব শরিয়ত পরিপন্থী আইন-কানুন রয়েছে সেগুলোর অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে তাহলে তা হারাম। এই বিষয়ে আমরা আরও বলি: শরিয়তের বিধান বাস্তবায়িত আছে এমন দেশেও যদি আইনজীবীর উদ্দেশ্য থাকে পাওনাদারের নিকট তার পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া তাহলে এই পেশায় প্র্যাকটিস করায় কোন সমস্যা নেই। কিন্তু যদি সে তার কথা ও ওকালতির মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা যে কোনও প্রকারে বিজয়ী হওয়ার মনোভাব রাখে তাহলে তা হারাম।”

❑ ২. মেয়েদের জন্য আইন নিয়ে পড়াশোনা করার বিধান:

প্রশ্ন: মেয়েরা কি আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে? আমার ছোট বোন পড়তে চাচ্ছে। কিন্তু আমি এতে ইচ্ছুক নই। কারণ যতটুকু জানি, এখানে পরিপূর্ণ পর্দা মানা যায় না। কিন্তু সবাইকে বুঝানোর মতন রেফারেন্স/দলিল না থাকায় আমার নিষেধ টা জোরালো হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে সাহায্য করবেন।
উত্তর: বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসলামি আইন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয় না তারপরও কেউ যদি দুর্বল, অসহায়, মজলুম-নিপীড়িত মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়া, সত্যের পক্ষে কথা বলা, ইসলামবিরোধী কার্যক্রমকে রুখে দেওয়া অথবা সাধারণ মানুষকে বৈধ ক্ষেত্রে আইনি সহায়তা করার উদ্দেশ্যে এই পেশায় সৎ ভাবে কাজ করা হয় তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। তবে কোন ভাবে জেনে-বুঝে মিথ্যা-জালিয়াতি, শরিয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ড অথবা জালিম বা অপরাধীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া বৈধ নয়। আর এ পেশায় নারীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কথা হল, ইসলামে নারীর জন্য পর্দা রক্ষা করা ফরজ। সুতরাং তার জন্য এমন পেশায় যুক্ত হওয়া বৈধ নয় যেখানে পর্দা লঙ্ঘিত হয় বা নারী-পুরুষ সহ অবস্থান করতে হয়। চাই তা আইন পেশা হোক অথবা অন্য কোনও পেশা।

❑ ৩. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইন পেশায় কাজ করা কি বৈধ?

প্রশ্ন: বাংলাদেশ তো মানব রচিত আইন বা কুফরি শাসন ব্যবস্থা দিয়ে চলে যা আপনার অজানা নয়। এমতাবস্থায় পেশা হিসেবে যদি কেউ যদি Lawyer/Advocate হিসেবে কাজ করে তাহলে কি তা বৈধ হবে? উল্লেখ্য যে, সে তার কাজে অসৎ, অন্যয়, মিথ্যা বা খারাপ কিছুর আশ্রয় না নিয়ে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করার চেষ্টা করবে-এমনটাই তার নিয়ত।
উত্তর: মানুষ অনেক সময় জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়, অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং অন্যের দ্বারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তারা বিভিন্ন কারণে ন্যায় বিচার পায় না। এক্ষেত্রে উকিল যদি তার পক্ষে কাজ করে তাকে জুলুম-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করে বা আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তার অধিকার ফিরিয়ে দেয় তাহলে নিঃসন্দেহে তা ভালো কাজ। বরং অসহায় মানুষকে সাহায্য করার নিয়ত থাকলে এতে সে সওয়াবের অধিকারী হবে। এটি পারস্পারিক সৎকর্মে সহায়তার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ
“সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর।” [সূরা মায়িদা: ২]

তবে এই পেশায় যারা কাজ করে তাদের জন্য মিথ্যা কথা বলা, অনৈতিক কাজ করা, ভুয়া ও জাল ডকুমেন্ট হাজির করা অথবা জেনেশুনে সত্য গোপন করা এবং জালিম ও অপরাধীর পক্ষে কাজ করা জায়েজ নেই- যা অনেক উকিল কেবল মামলায় জেতার উদ্দেশ্যে করে থাকে (নাউযুবিল্লাহ)। যে আইনজীবী এসব কাজ করবে সে গুনাহগার হবে এবং এর মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ তার জন্য হারাম বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে কোন উকিলের জন্য অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা, জালিম ও অপরাধীকে সাহায্য করা, আইনের মার-প্যাঁচে ফেলে কারো অধিকার হরণ করা অথবা শরিয়ত বহির্ভূত কোনও কাজে কাউকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে ওকালতি করা কোনোভাবেই বৈধ নয়। কেননা তা পাপকর্মে সহায়তার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

“তোমরা পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।” [সূরা মায়িদা: ২]

◈ আল্লামা শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. কে আইন পেশা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেন,

فإذا كان المحامي يتقي الله، ولا يساعد صاحبه بالمنكر والكذب؛ فلا حرج عليه، الواجب عليه أن يتقي الله في محاماته، وأن يطالب بالحق، وألا يكذب، وألا يعين صاحبه على معصية الله، فإذا كان يطالب بالحق الذي يعلمه، أو يطلب من القاضي الحكم بالشرع الذي يعلمه القاضي، ولا يعلمه المحامي؛ فلا حرج عليه في ذلك.
أما أن يتعمد كذبًا، أو إعانة على كذب، أو على غش؛ فلا يجوز له، وهو آثم في ذلك وظالم،

“অতএব উকিল যদি আল্লাহকে ভয় করে এবং বিচার প্রার্থীকে অন্যায় ও মিথ্যা-জালিয়াতির মাধ্যমে সাহায্য না করে তাহলে ‌এতে কোন দোষ নেই। তার জন্য আবশ্যক হল, আইন পেশার ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করা। সে (আদালতে বিচারকের নিকট) পাওনা দাবি করবে। এ ক্ষেত্রে কোনও ধরণের জালিয়াতির আশ্রয় নিবে না এবং বিচার প্রার্থীকে ‌আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে না।
অত:এব সে যদি এমন পাওনা দাবি করে যা সে জানে অথবা সে বিচারকের নিকট আল্লাহর আইন অনুযায়ী ফয়সালা চায় যে বিষয়ে বিচারক জ্ঞান রাখে; আইনজীবী হয়ত সে বিষয়ে জ্ঞান রাখে না তাহলে তাতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সে যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা কথা বলে অথবা অসত্য ও প্রতারণার ক্ষেত্রে সহায়তা করে তাহলে তা জায়েজ নাই। এতে সে জুলুমকারী ও গুনাহগার হবে।”

❑ ৪. প্রশ্ন: কোন মুসলিম কি কোন হিন্দু বা অন্য ধর্মের আইনজীবী দ্বারা মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করা জায়েজ?
উত্তর: ন্যায় বিচার পাওয়ার স্বার্থে যদি কোন অমুসলিম আইনজীবীকে আইন ও মামলা পরিচালনায় অধিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও পারঙ্গম মনে হয় তাহলে তার মাধ্যমে মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করা দূষণীয় নয় যদি সে এ ক্ষেত্রে শরিয়ত বিরোধী কোন কাজ না করে। যেমন: মিথ্যা ও জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য হাজির করা, ডকুমেন্ট জাল করা, উৎকোচ প্রদান ইত্যাদি। এ সকল অন্যায় ও অসৎ উপায় অবলম্বন করা সর্বাবস্থায় সকলের জন্য গর্হিত কাজ ও নিষিদ্ধ-চাই সে মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম হোক।

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রয়োজনবোধে দুনিয়াবি প্রয়োজনীয় কাজে অর্থের বিনিময়ে বিশ্বস্ত এবং অভিজ্ঞ অমুসলিমকে নিয়োগ দেওয়া জায়েজ। যেমন: আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের প্রাক্কালে মক্কা থেকে মদিনার রাস্তা দেখানোর উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহ বিন উরাইকিতকে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছিলেন যদিও সে সময় সে মুশরিক ছিল। [সিরাত গ্রন্থ সমূহ] আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।