প্রশ্ন: আমাদের এখানকার একজন আলেম বলেছেন, সনদ যাচাই ছাড়া নাকি হাদিস প্রচার করা ঠিক নয়। কিন্তু ফেসবুকে দেখি, সনদের অবস্থা বা হাদিসের মান বর্ণনা ছাড়াই অনেকেই হাদিস প্রচার করে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
উত্তর:
উক্ত আলেম সঠিক কথাই বলেছেন।
হাদিস বর্ণনা করা, প্রচার করা, হাদিস দ্বারা ওয়াজ করা, বক্তৃতা দেয়া কিংবা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ওয়েব সাইটে হাদিস পোস্ট করার পূর্বে তার বিশুদ্ধতা যাচাই করা অপরিহার্য।কারণ:
● রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি বাণী মুসলিম জাতির জন্য সংবিধানের একেকটি ধারার সমতুল্য।
● তাঁর প্রতিটি বাণী মানবজাতির মুক্তির পথনির্দেশক।
● তাঁর প্রতিটি নিষেধাজ্ঞা মানবজাতির জন্য ধ্বংসাত্মক।
এসব কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসগুলো বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত হওয়া আবশ্যক।
● তা ছাড়া ফেইক ও ভূয়া হাদিসের কারণে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায় এবং অমুসলিম ও নাস্তিকরা ইসলাম নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার সুযোগ পায়।
● জাল-জঈফ হাদিসের কারণে সমাজে নানা কুসংস্কার ও বিভ্রান্তি ছাড়ায়।
● মানুষের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হয়।
● সমাজে ধর্মের নামে নতুন নতুন বিদআত, বাতিল মতবাদ ও ফিরকা সৃষ্টি হয়।
● শুধু তাই নয়, একটি হাদিসকে কেন্দ্র করে দুটি জাতির মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে তারা ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।
● আবার একটি হাদিসের ভুল বুঝ বা ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে শুরু হতে পারে নানা বিশৃঙ্খলা, ধর্মীয় ক্ষেত্রে সৃষ্টি হতে পারে নানা বিদআত এবং ধর্মের নামে অধর্ম।
আল্লাহ তায়ালা তাআলা তথ্য যাচাইয়ের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন:
إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَأٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ
“হে মুমিনগণ, যদি কোন ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত: তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও।” (সূরা হুজুরাত: ৬)
জীবনের বহু বিধিবিধান তার হাদিসের উপর নির্ভরশীল। দুনিয়ার সফলতা এবং আখিরাতের মুক্তি নির্ভর করছে তার আদেশ ও নিষেধগুলো পালনের উপর।
অতএব তাঁর নামে হাদিস বলার আগে অবশ্যই সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করা জরুরি। হাদিসের নামে যা বলা হচ্ছে তা বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া অপরিহার্য। কোন দুর্বল বা বানোয়াট সনদ এর উপরে ভিত্তি করে কোন হাদিস বলা হলে সেটা রসূল সাল্লাল্লাহু ইসলামের নামে মিথ্যাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সুতরাং কেউ কোন হাদিস পেশ করলে তার জন্য আবশ্যক হল, হাদিসের উৎস ও মান (সহিহ-জঈফ) উল্লেখ করা এবং সর্তক হওয়া যে, কোন মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস যেন প্রকাশ না পায় বা সমাজে ছড়িয়ে না পড়ে।
◖তাই তো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করে দিয়ে বলেন:
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার উপর মিথ্যা রোপ করল (মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করল), সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা করে নিলো।” (সহিহ বুখারি, অনুচ্ছেদ: আম্বিয়াদের হাদিস, হাদিস নং ৩২৭৪)
◖তিনি আরও বলেন:
كفى بالمرء كذباً أن يحدث بكل ما سمع
“মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।” (সহিহ মুসলিম এর ভূমিকা, আবু দাউদ ৪/২৯৮, ইবনে হিব্বান, ১/২১৩ )
◖অন্য বর্ণনায় এসেছে
كفى بالمرء إثما أن يحدث بكل ما سمع
“গুনাহ হওয়ার জন্য এতটুকুই এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।” (সিলসিলা সহিহা হা/২০২৫)
❖❖ হাদিস বর্ণনায় সাহাবিদের অভূতপূর্ব সতর্কতা:
সাহাবায়ে কেরাম ও এবং আমাদের পূর্বসূরিগণ হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করতেন। এ মর্মে বহু বক্তব্য ও ঘটনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিন্মোক্ত দুটি বর্ণনাই যথেষ্ট আশা করি:
◍ যেমন:
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي لَيْلَى، قَالَ قُلْنَا لِزَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ حَدِّثْنَا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ . قَالَ كَبِرْنَا وَنَسِينَا وَالْحَدِيثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ شَدِيدٌ .
আব্দুর রহমান ইবনে আবু লাইলা (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ)-কে বললাম, আমাদের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস বর্ণনা করুন। তিনি বলেন, “আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি এবং (অনেক কিছুই) ভুলে গেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস বর্ণনা করা খুবই কঠিন দায়িত্ব।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ ভূমিকা পর্ব (كتاب المقدمة) অনুচ্ছেদ: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর হাদিস বর্ণনায় সতর্কতা অবলম্বন করা। হা/২৫-সহিহ)
◍ আরেকটি ঘটনা
، عَنْ عَمْرِو بْنِ مَيْمُونٍ، قَالَ مَا أَخْطَأَنِي ابْنُ مَسْعُودٍ عَشِيَّةَ خَمِيسٍ إِلاَّ أَتَيْتُهُ فِيهِ قَالَ فَمَا سَمِعْتُهُ يَقُولُ لِشَىْءٍ قَطُّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ فَلَمَّا كَانَ ذَاتَ عَشِيَّةٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ – قَالَ فَنَكَسَ . قَالَ فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ فَهُوَ قَائِمٌ مُحَلَّلَةً أَزْرَارُ قَمِيصِهِ قَدِ اغْرَوْرَقَتْ عَيْنَاهُ وَانْتَفَخَتْ أَوْدَاجُهُ قَالَ أَوْ دُونَ ذَلِكَ أَوْ فَوْقَ ذَلِكَ أَوْ قَرِيبًا مِنْ ذَلِكَ أَوْ شَبِيهًا بِذَلِكَ
আমর বিন মায়মুন থেকে বর্ণিত, প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হতে আমার ভুল হতো না। কিন্তু আমি কখনও তাঁকে “রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন” এভাবে কিছু বলতে শুনিনি। এক রাতে তিনি বলেন, “রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন”।
রাবি বলেন, অতঃপর তিনি মাথা নিচু করলেন।
রাবি বলেন: আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন যে, তার জামার বোতাম খোলা, তার চক্ষুদ্বয় অশ্রু বিগলিত এবং এর শিরাগুলো ফুলে গেছে।
অতঃপর তিনি বলেন: তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই বলেছেন অথবা এর অধিক বা কম বলেছেন অথবা এর কাছাকাছি বা এর অনুরূপ বলেছেন (অর্থাৎ তিনি যা বলেছেন তা আমার হুবহু মনে নেই)।
[মুসনাদে আহমদ ৪৩০৯, ২৭০। তাহকিক আলবানী: সহিহ।]
এ সকল আয়াত, হাদিস ও সাহাবিদের বক্তব্য থেকে হাদিস বর্ণনার পূর্বে তাহকিক করা বা হাদিসের সনদ ও মতনের নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি প্রতিভাত হয়।
সুতরাং হাদিস বর্ণনায় সতর্কতা অবলম্বন করা এবং ওয়াজ মাহফিল, ইসলামি আলোচনা সভা, পত্র-পত্রিকা, ফেসবুক ইত্যাদিতে জাল-জঈফ হাদিস প্রচার থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।
বিশেষ করে, ফেসবুক ও নেট দুনিয়ায় ভুল হাদিস প্রচারের ভয়াবহতা ও ক্ষতি মারাত্মক। কেননা কোনও কিছু এক বার নেট জগতে ঢুকে গেলে মানুষ তা কপি-পেস্ট করতেই থাকে। এক জায়গা থেকে কতশত জায়গায় যে তা ছড়িয়ে পড়ে তার কোনও ইয়ত্তা নাই। নিজের ভুল সংশোধন করা গেলেও চারিদিকে তা ছড়িয়ে পড়লে তখন ভুল সংশোধন প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
সুতরাং বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর ও আতঙ্কের। তাই কোন হাদিস পাওয়া মাত্রই যাচায়-বাছায় ছাড়া শেয়ার বা প্রচার করে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
অজানা বশত কোন ভুল হয়ে গেলে মহান আল্লাহর নিকট দুআ করি, তিনি যেন নিজ দয়ায় তা ক্ষমা করে দেন। অন্যথায় আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। আমরা তার ক্ষমার ভিখারি। নিশ্চয় তিনি পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।