প্রশ্ন: কেবল কুরআন তিলাওয়াত করা বেশি উত্তম নাকি অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সহকারে পড়া উত্তম? কোনটির ফজিলত বেশি সহিহ হাদিসের আলোকে জানতে চাই।
উত্তর:
আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবর্তীণ করেছেন মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্য। যেন মানুষ কুরআন থেকে দিক-নির্দেশনা খুঁজে পায়। কুরআনের বিধান অনুযায়ী সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করে। কিন্তু আমরা যদি কুরআনে মর্মবাণী উপলব্ধি করার চেষ্টা না করে..কিছু না বুঝে..চিন্তা-গবেষণা না করে কেবল তোতাপাখির মত কুরআন আবৃতি করে যাই তাতে প্রতি অক্ষরে দশটি করে নেকি অর্জন করা গেলেও কুরআন থেকে হেদায়েত ও নির্দেশনা লাভ করা সম্ভব হবে না। তাই কুরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি কুরআনের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু কেবল বেশি পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা উত্তম না কি তরজমা, তাফসির ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সহকারে কুরআন পাঠ করা অধিক উত্তম সে বিষয়ে আলেমদের মাঝে দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়।
অনেক আলেমের মতে, তরজমা, তাফসির ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সহকারে কুরআন পাঠ করা অধিক উত্তম না বুঝে আবৃতি করার চেয়ে। তাদের মতে তিলাওয়াতের পরিমাণ কম হলেও বুঝে বুঝে কুরআন থেকে হেদায়েত লাভ করার নিয়তে ধীরেসুস্থে পাঠ করা উচিৎ। কেননা-
◈ আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ
“আমি কুরআনকে বোঝার জন্যে সহজ করে দিয়েছি। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি? ” [সূরা কামার: ২২]
◈ তিনি আরও বলেছেন,
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
“তারা কি কুরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবন্ধ?” [সূরা মুহাম্মদ: ২৪]
◈ প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লহ ইবনে মাসঊদ রা. বলেন,
كُنَّا لَا نَتَجَاوَزُ عَـشْرَ آيَاتٍ حَتَّى نَتَعَلَّمَهُنَّ وَنَعْمَلَ بِهِنَّ، وَنُعَلِّمَهُنَّ، وَنَعْلَمَ حَلَالَهُنَّ وَحَرَامَهُنَّ، فَأُوتِينَا العِلْمَ وَالعَمَلَ
“আমরা দশ আয়াত অতিক্রম করতাম না যতক্ষণ না সেগুলো শিখে আমল করতাম এবং সেগুলোর হালাল-হারাম জানতাম। ফলে আমরা ইলম ও আমল দুটাই পেয়েছিলাম।” [সহিহুত তারগিব-আলবানী]
◈ আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলতেন,
لاَ تَنْثِرُوهُ نَثْرَ الدَّقْلِ وَلاَ تَهُدُّوهُ هَدَّ الشِّعْرِ، قِفُوا عِنْدَ عَجَائِبِهِ، وَحَرِّكُوا بِهِ الْقُلُوبَ، وَلاَ يَكُونُ هَمُّ أَحَدِكُمْ آخِرَ السُّورَةِ
أخرجه ابن أبي شيبة في المصنف (8733).
“তোমরা কুরআনকে কবিতা পড়ার মতো দ্রুত পড়ো না এবং পুরাতন খেজুরের ন্যায় এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিও না। কুরআনের বিস্ময়কর বিষয়গুলো সামনে এলে একটু থামো এবং অন্তরকে নাড়া দাও। সূরার শেষ পর্যন্ত পৌঁছাটাই যেন তোমাদের মূল লক্ষ্য না হয়।” [মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা]
◈ তিনি এও বলতেন,
إذا سمعتَ قول الله : “يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا” فأصغِ لها سمعك .. فإنه خيرٌ تُؤمر به .. أو شرٌّ تُصرف عنه ..”
(কুরআনে) যখন শোনো, আল্লাহ বলছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا “হে ঈমানদারগণ!” তখন (পরবর্তী কথা শোনার জন্য) মনোযোগী হও। কারণ, এরপর হয়তো কোনও ভালো কাজের নির্দেশ দেয়া হবে কিংবা কোনও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হবে। [যাদুল মা’আদ : ১/৩৩৭-৩৪০]
▊▍ পক্ষান্তরে একদল আলেমের মতে, তরজমা, তাফসির জানার চেয়ে অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা উত্তম। কেননা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ»
‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ।’’ [সুনান আত-তিরমিযি/সহিহ] এ ছাড়াও তারা সাহাবি ও তাবেঈদের অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত সংক্রান্ত আসার সমূহ দ্বারা দলিল পেশ করেন।
যাহোক, এ ব্যাপারে কোনও কোন আলেমের অভিমত হল, যে ব্যক্তি আরবি ভাষা বুঝে এবং কুরআন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে তাহলে কেবল অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা উত্তম। কিন্তু কেউ যদি কুরআন না বুঝে বা কুরআন সম্পর্কে ভালো জ্ঞান না রাখে তাহলে তার জন্য তরজমা, তাফসির ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সহকারে পাঠ করা উত্তম।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমানে বহু মানুষ আছে, যারা কুরআন তিলাওয়াত করে ঠিকই কিন্তু তাদের জীবনাচার প্রমাণ করে না যে, তারা কুরআন থেকে হেদায়েত ও শিক্ষা লাভ করেছে। তাদের চরিত্র, আচার-আচরণ, পারিবারিক ও সামাজিক কার্যক্রম, কথাবার্তা ইত্যাদি সব কুরআনের বিপরীত। সত্যিকার অর্থে এসব লোকেদের কুরআন তিলাওয়াত করেও ‘কুরআন পরিত্যাগ কারী’ হিসেবে আল্লাহর কাছে দণ্ডায়মান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমীন।
❑ কুরআনকে কিভাবে পরিত্যাগ করা হয়?
আল্লামা ইবনুল কায়্যেম রহ. বলেন, কুরআনকে কয়েক ভাবে পরিত্যাগ করা হয়। যথা:
◉ এক: কুরআন শ্রবণ না করা, কুরআনের প্রতি বিশ্বাস পোষণ না করা এবং কুরআনের প্রতি মনোযোগ না দেয়া।
◉ দুই: আমল না করা, বৈধ-অবৈধের প্রতি তোয়াক্কা না করা। যদিও পড়ে এবং বিশ্বাস করে।
◉ তিন: দ্বীনের মৌলিক এবং শাখা সর্বক্ষেত্রে কুরআনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ না করা।
◉ চার: কুরআনের অর্থ এবং ব্যাখ্যা না জানা এবং কুরআনের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা কি বলতে চেয়েছেন তা অনুধাবন করার চেষ্টা না করা।
◉ পাঁচ: প্রবৃত্তি মনের যাবতীয় রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা করতে কুরআন থেকে সাহায্য না নেয়া।
উল্লেখিত বিষয়গুলো সবই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যেখানে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآَنَ مَهْجُورًا
“আর রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে আমার পরওয়ারদেগার, আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে। (সূরা ফুরকান: ৩০) যদিও উল্লেখিত দিকগুলো কোনটা বেশী কঠিন; কোনটা তুলনা মূলক হালকা।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে যথাসাধ্য অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি কুরআনের মমার্থ, আবেদন ও আহ্বানকে হৃদয়ে উপলদ্ধি করত: সে আলোকে আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি সহ জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগকে ঢেলে সাজানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহ আলাম।
▬▬▬▬◆◈◆ ▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।