সহজ-সরল ও কোমল স্বভাবের মানুষের জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম এবং নম্রতা ও কঠোরতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কেমন হওয়া উচিৎ

প্রশ্ন: নিম্নের হাদিসটির ভাবার্থ কী এবং হাদিসটি কি সহিহ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি সহজ-সরল ও কোমল হবে, সে ব্যক্তির জন্য আল্লাহ জাহান্নামকে হারাম করে দেবেন।” [সহিহ আল-জামি: ৬৪৮৪] এবং নম্রতা ও কঠোরতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কেমন হওয়া উচিৎ?

উত্তর: নিম্নে সংক্ষেপে উপরোক্ত প্রশ্নদ্বয়ের উত্তর দেওয়া হলো:

প্রবীণ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

حُرِّمَ عَلَى النَّارِ كُلُّ هَيِّنٍ لَيِّنٍ سَهْلٍ قَرِيبٍ مِنْ النَّاسِ

“জাহান্নামের আগুনের জন্য হারাম যে ব্যক্তি শান্ত-শিষ্ট, নম্র, সহজ-সরল চরিত্রের অধিকারী হবে আর মানুষের কাছাকাছি অবস্থান করবে।” [তিরিমিজি-২৪৮৮, ইবনে হিব্বান-৪৬৯, মুসনাদে আহমদ- সহিহ]। অন্য এক হাদিসে এসেছে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

أَلَا أُخْبِرُكم بمَن يَحْرُمُ على النَّارِ، وبمَن تَحْرُمُ عليه النَّارُ؟ على كلِّ قريبٍ هيِّنٍ سهْلٍ.

“আমি কি তোমাদের এমন ব্যক্তির কথা জানাবো, যে জাহান্নামের ওপর হারাম এবং যার ওপর জাহান্নাম হারাম? সে হলো প্রতিটি নিকটবর্তী (মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে), কোমল স্বভাবের ও সহজ-সরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি।” [সুনান তিরমিজি: ২৪৮৮, সহিহ হাদিস]

অর্থাৎ আমি কি তোমাদের এমন ব্যক্তির কথা জানাবো, যে আগুন (জাহান্নাম) থেকে রক্ষা পাবে, অথবা আগুন যার থেকে দূরে থাকবে? সে হলো—প্রতিটি মানুষের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা, তাদের সঙ্গে কল্যাণের আসনে বসা এবং যথাসাধ্য তাদের সঙ্গে নম্রতা ও ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পর্ক রাখা। আর সে হলো প্রতিটি সহনশীল, কোমল স্বভাবের এবং মানুষের সঙ্গে সহজ-সরল আচরণকারী ব্যক্তি।

❂ উক্ত হাদিসদ্বয় থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. উত্তম চরিত্রের গুরুত্ব এবং এটি জাহান্নাম থেকে রক্ষার উপায়।
২. মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করা, সহজ-সরল আচরণ করা এবং তাদের প্রয়োজন পূরণে সহযোগিতা করা প্রশংসনীয়।
৩. উত্তম চরিত্র ও সুন্দর আচরণ ঈমানের অংশ।
৪. দাঈ বা আহ্বানকারীর জন্য উৎসাহমূলক ভাষা ব্যবহার করা উচিত, যা মানুষকে সত্য গ্রহণ ও তাতে দৃঢ় থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে।
৫. শিক্ষার্থী বা শ্রোতাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি মনোযোগী করা উচিত।

মোটকথা, যে ব্যক্তি স্বভাবগতভাবে শান্ত-শিষ্ট হবে, উগ্র হবে না, কঠিন ও রূঢ় স্বভাবের হবে না, সহজ-সরল হবে, জটিলতা ও কুটিলতা মুক্ত হবে, নরম ও কোমল স্বভাবের অধিকারী হবে, সে আল্লাহর বিধানের কাছে সহজে আত্মসমর্পণ করবে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শে নিজেকে বিলিয়ে দেবে, মানুষের কল্যাণে কাজ করবে, তার চেহারায় হাসির ঝিলিক লেগে থাকবে, তার মুখের ভাষা হবে কোমল এমন উন্নত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের জন্য মহান আল্লাহ জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন।

❑ রাগ করা বা কঠোরতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কী হওয়া উচিত?

পরিস্থিতি ও অবস্থার আলোকে নম্রতা ও কঠোরতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। কারণ প্রত্যেকটি জিনিসের নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্র আছে। উপরোক্ত গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো সাধারণ জীবনযাত্রা,পারস্পারিক লেনদেন ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজন মুমিনের মধ্যে থাকা উচিত। তবে অবস্থা ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী কখনো কঠোর হতে হয়। কখনো শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। কখনো রাগ করতে হয়। যেখানে নম্রতা দেখানোর জায়গা, সেখানে কঠোরতা অবলম্বন করলে কোনো উপকার হয় না। আবার কঠোর হওয়ার জায়গায় নম্রতা দেখালে আরও বেশি ক্ষতি হয়। আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন থেকে এই শিক্ষা পাই।

➧ উল্লেখ্য যে, এখানে একজন মুমিনের স্বভাব, ব্যক্তিত্ব আচরণের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং একজন এমন সৎ ও উত্তম চরিত্রের মানুষের জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম। কিন্তু যার মধ্যে আদৌ ইমান নেই অথবা খাঁটি মুমিনের বৈশিষ্ট্যগুলো তার মধ্যে অনুপস্থিত তার মুক্তি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ আখিরাতে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ইমান ও আমলে সালেহ (সৎকর্ম) থাকা অপরিহার্য শর্ত। তারপর তার অন্যান্য গুণ-বৈশিষ্ট্য বিচার্য হবে।

❂ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নম্রতা ও কঠোরতা:

আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন, দয়ালু ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন:

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّـهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ

“আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন; পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠোর হৃদয়ের হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।” [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]
তিনি বহু হাদিসে রাগ করতে নিষেধ করেছেন। অন্যদিকে এটাও বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর বিধান লঙ্ঘিত হলে তিনি এত বেশি রাগ করতেন যে, তখন তাঁর সামনে যাওয়ার কারও সাহস হতো না।

– একবার এক কুরাইশি নারীর চুরির ঘটনায়, যখন তাঁর কাছে তাকে সম্ভ্রান্ত বংশের নারী হিসেবে ক্ষমা করে দেওয়ার আবেদন করা হলো, তখন তিনি রাগতস্বরে বক্তৃতায় বললেন:

أمَّا بَعْدُ؛ فإنَّما أهْلَكَ النَّاسَ قَبْلَكُمْ: أنَّهُمْ كانُوا إذا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ، وإذا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أقامُوا عليه الحَدَّ، والذي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بيَدِهِ، لو أنَّ فاطِمَةَ بنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ، لَقَطَعْتُ يَدَها.

“অতঃপর, শুনো, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে এই কারণে যে, তাদের মধ্যে কোনো সম্মানিত ব্যক্তি চুরি করলে তাকে ছাড় দেওয়া হতো, আর যদি কোনো দুর্বল ব্যক্তি চুরি করত, তবে তার ওপর (শাস্তির) হদ প্রয়োগ করা হতো। আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।”

এরপর তিনি সেই নারীর জন্য হুকুম দিলেন, এবং তার হাত কেটে ফেলা হলো। [সহিহ বুখারি: ৬৭৮৮, সহিহ মুসলিম: ১৬৮৮]

– আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: “নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছে প্রবেশ করলেন, তখন ঘরে একটি পর্দা ছিল, যাতে ছবি আঁকা ছিল। এটি দেখে তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেল। এরপর তিনি সেই পর্দাটি ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেন: ‘কিয়ামতের দিনে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে তাদের, যারা এইসব (জীবিত প্রাণীর) ছবি অঙ্কন করে।’” (সহিহ বুখারি: ৫৯৫৪, সহিহ মুসলিম: ২১০৭)

এ ছাড়াও আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখন কোথায় কেন রাগ করেছেন সে ব্যাপারে অনেক হাদিস রয়েছে। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত কারণে রাগ করতেন না।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ ۚ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ

“মুহাম্মাদ আল্লাহর রসুল, আর যারা তাঁর সঙ্গে আছে, তারা কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পর দয়ালু।” [সূরা ফাতহ: ২৯]

উপসংহার:
অন্যায় প্রতিরোধ করতে হলে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। আর মানুষের সঙ্গে লেনদেনে নম্র, সহজ-সরল ও সদাচারী হওয়া উচিত। আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: