সফর মাস হলো, হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২য় মাস। এ মাসে কুরআন-সুন্নাহ কিংবা সালাফদের আমল থেকে বিশেষ কোনও ইবাদত-বন্দেগি সাব্যস্ত হয়নি।
সুতরাং এ মাসে অন্যান্য মাসের মতোই ইবাদত-বন্দেগি করার চেষ্টা করা কর্তব্য।
নিম্নে কিছু ইবাদত-বন্দেগির তালিকা উপস্থাপন করা হলো-যেগুলো সফর মাস সহ যে কোনও মাসের জন্য প্রযোজ্য:
১. পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাত সময় হওয়ার সাথে সাথে ভয়-ভীতি, বিনয় নম্রতা ও আন্তরিকতার সহকারে আদায় করা। মহিলারা বাড়িতে এবং পুরুষেরা মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করবে।
২. দিনে-রাতে ১২ রাকাত সুন্নত আদায় করা।
৩. সূর্য উদিত হওয়ার কমপক্ষে ১৫ মিনিট পরে দু রাকাত ইশরাকের সালাত আদায় করা।
৪. সূর্যের কিরণ প্রখর হলে (অনুমানিক সকাল ১০-১১টা বা তার কিছু আগে-পরে) চাশত (যুহা/আওয়াবিন) এর দুই থেকে আট রাকাত নফল সালাত আদায় করা।
৫. অজু করার পরে ওজুর দুই রাকাত সালাত আদায় করা।
৬. মসজিদে প্রবেশ করলে বসার পূর্বে দুই রাকাত সালাত (দুখুলুল মাসজিদ/তাহিয়াতুল মাসজিদ) আদায় করা।
৭. মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে যথাসাধ্য নফল সালাত আদায় করা।
৮. তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা।
৯. রমজান মাসে বিশেষভাবে তারাবিহর সালাত আদায় করা।
১০. দিনরাত যখন ইচ্ছা যতটুকু সম্ভব নফল সালাত আদায় করা (নিষিদ্ধ সময়গুলো ছাড়া)।
১১. রমজান মাসে ফরজ রোজা রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় যথাসাধ্য নফল রোজা রাখা। যেমন:
– প্রত্যেক সোমবার ও বৃহস্পতিবার দুটি নফল রোজা রাখা।
– প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩-১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বীজের তিনটি রোজা রাখা।
– কিংবা সারা মাসে সুবিধা জনক সময়ে তিনটি রোজা রাখা।
– সম্ভব হলে একদিন পর একদিন রোজা রাখা (নিষিদ্ধ দিনগুলো ছাড়া)।
– মৌসুম ভিত্তিক নফল রোজাগুলো রাখা। যেমন: আরাফার রোজা, মুহররমের ৯ ও ১০ কিংবা ১০ ও ১১ তারিখে দুটি রোজা রাখা, জিলহজ মাসের প্রথম দশকে রোজা রাখা ইত্যাদি।
১২. অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা এবং কুরআনের তরজমা ও তাফসির জানার চেষ্টা করা।
১৩. কুরআন তিলাওয়াত শোনা।
১৪. সকাল সন্ধ্যা, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে এবং ঘুমের পূর্বের জিকির ও দুআগুলো নিয়মিত পাঠ করা।
১৫. দিনরাত কাজের ফাঁকে ফাঁকে, রাস্তায় চলার সময়, বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের সময়, যানবাহনে থাকা অবস্থায়, কারো জন্য অপেক্ষার সময় ইত্যাদি সময়গুলো অধিক পরিমাণে তাসবিহ, জিকির, দরুদ, ইস্তিগফার ইত্যাদি পাঠ করা।
১৬. ঘুমাতে যাওয়া, ঘুম থেকে ওঠা, টয়লেটে প্রবেশ করা, টয়লেট থেকে বের হওয়া, খাওয়ার আগে ও পরে, কাপড় পরার আগে, কাপড় খুলে রাখার সময়, স্ত্রী সহবাসের পূর্বে, বাড়ি থেকে বের হওয়া অতঃপর বাড়িতে প্রবেশ করা, মসজিদে প্রবেশ করা ও বের হওয়া, যানবাহনে ওঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ দুআগুলো পাঠ করা।
১৭. যে কোনও বৈধ কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ পাঠ করা।
১৮. জাকাত ফরজ হয়ে থাকলে তা আদায়ের পাশাপাশি গরিব-অসহায় মানুষ, বিশেষ করে নিকটাত্মীয়দেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা।
১৯. জনকল্যাণ কাজে অথবা মাদরাসা, মসজিদ, ইসলামি পাঠাগার, অফলাইন বা অনলাইনের মাধ্যমে দাওয়াতি কাজ ইত্যাদি জন্য অর্থ খরচ করা ইত্যাদি।
২০. পিতা-মাতা, ভাই-বোন এবং অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
২১. স্ত্রী ও সন্তানদের হক আদায় করা এবং তাদের প্রয়োজন পূরণে উদার হাতে খরচ করা।
২২. হজ ফরজ হলে তা অনতিবিলম্বে আদায় করা এবং যথাসাধ্য অধিক পরিমাণে ওমরা আদায় করা।
উল্লেখ্য যে, এই সকল ইবাদত বন্দেগি নির্দিষ্ট কোন মাসের সাথে সম্পৃক্ত নয় বরং বছর ব্যাপী যে কোন সময় এই সহজ ইবাদতগুলো করা যেতে পারে যথাসাধ্য অনুযায়ী। আল্লাহ তওফিক দান করুন।
❑ সফর মাসে যে সকল কাজ বর্জনীয়:
◈ ১.আখেরি চাহার শোম্বার নামাজ ও অন্যান্য বিদআতি আমল:
সফর মাসের শেষ বুধবারের কোনও প্রকার বিশেষত্ব হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এ দিনে কোনোরূপ ইবাদত, নামাজ, রোজা, জিকির, দুআ, দান-সদকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য কোনও দিনের চেয়ে বেশি বা বিশেষ কোনও সোওয়াব বা বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারণা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।
তাযকিরাতুল আখিরাত, মকছুদুল মুমিনিন, বারো চান্দের আমল এজাতীয় কিছু বইয়ে আখেরি চাহার সোম্বার বিশেষ নামাজ ও কিছু বিশেষ আমলের উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আখেরি চাহার সোম্বার নামাজের নিয়ম হিসাবে বলা হয়ে থাকে, সফর মাসের শেষ বুধবার সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর ২ রাকাত নামাজ পড়তে হবে। সে নামাজের উভয় রাকাতে সূরা ইখলাস ১১ বার করে পড়তে হবে এবং নামাজ শেষে ৭০ বার বিশেষ দরূদ ও দুআ পড়তে হবে।
উক্ত নামাজ সম্পর্কে আল্লামা আব্দুল হাই লখনৌভি রাহ. লিখেছেন, “সফর মাসের শেষ বুধবারে যে বিশেষ নফল নামাজ বিশেষ কিছু সুরা, আয়াত ও দুআ পাঠের মাধ্যমে আদায় করা হয়, তা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এছাড়াও আখেরি চাহার সোম্বার দিন বিশেষ দুআ পড়ে পানিতে ভিজিয়ে পান করা ও সেই পানি দিয়ে গোসল করার একটি রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। এটিও মনগড়া, বানোয়াট একটি রেওয়াজ।”
◈ ২. সফর মাসকে অশুভ ও বালা-মুসিবতের মাস মনে করা একটি জাহেলি কুসংস্কার:
কোনও স্থান, সময়, বস্তু বা কর্মকে অশুভ বা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামি বিশ্বাসের পরিপন্থী একটি কুসংস্কার। আরবের মানুষরা জাহেলি যুগ থেকে সফর মাসকে অশুভ ও বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এই ভুল ধারণা খণ্ডন করেছেন। হাদিসে আছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لاَ عَدْوَى وَلاَ صَفَرَ وَلاَ هَامَةَ
“রোগের কোনও সংক্রমণ নেই, সফরের কোনো কুলক্ষণ নেই, পেঁচার মধ্যেও কোনও কুলক্ষণ নেই। [সহীহ বুখারী, হাদিস/৫৭১৭]
আরেক হাদিসে আছে, জাহিলি যুগে লোকেরা সফর মাসকে অমঙ্গলের মাস হিসাবে বিবেচনা করত, এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “না, সফর মাস এরূপ নয়।” [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩৯১৫]
অথচ এরপরও মুসলিম সমাজে অনেকের মধ্যে পূর্ববর্তী যুগের এ সকল কুসংস্কার থেকে যায়। শুধু তাই নয়, এ সকল কুসংস্কারকে উস্কে দেওয়ার জন্য অনেক বানোয়াট কথা বানিয়ে হাদিসের নামে সমাজে প্রচার করছেন অসতর্ক কতিপয় বক্তা।
তারা জালিয়াতি করে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বলছেন, এই মাস বালা-মুসিবতের মাস। এই মাসে এত লক্ষ এত হাজার বালা নাজিল হয়। এই মাসেই আদম আলাইহিস সালাম ফল খেয়েছিলেন। এ মাসেই হাবীল নিহত হন। এ মাসেই নূহ আলাইহিস সালামের কওম ধ্বংস হয়। এ মাসেই ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে ফেলা হয়। এ মাসের আগমনে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যথিত হতেন। এই মাস চলে গেলে খুশি হতেন। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করবে, আমি তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করার সুসংবাদ প্রদান করব।’ এরকম অনেক কথা তারা বানিয়েছে।
আর অনেক সরলপ্রাণ মুসলিমগণ তাদের এ সকল জালিয়াতি বিশ্বাস করেছেন। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, সফর মাসের অশুভত্ব ও বালা মুসিবত বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।
◈ ৩. সফর মাসের ১ম রাতের নামাজ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট আমল:
উপরোক্ত মিথ্যা কথাগুলোর ভিত্তিতেই একটি ভিত্তিহীন ‘নামাজের’ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ যদি সফর মাসের ১ম রাতে মাগরিবের পরে বা ইশার পর চার রাকাত নামাজ আদায় করে, অমুক অমুক সূরা বা আয়াত এত বার পাঠ করে, তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, এত এত পুরস্কার পাবে ইত্যাদি। এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা-যদিও অনেক সরলপ্রাণ মানুষ এগুলি বিশ্বাস করেছেন এবং কেউ কেউ নিজেদের বইয়ে ও ওয়াজে উল্লেখ করেছেন।
◈ ৪. সফর মাসের শেষ বুধবার:
বিভিন্ন জাল হাদিসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যেকোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ, সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে অশুভ দিন এবং এই দিনে সবচেয়ে বেশি বালা মুসিবত নাজিল হয়। এসব ভিত্তিহীন কথাবার্তা অনেক সরলপ্রাণ মুসলমান বিশ্বাস করেছেন।
একজন লিখেছেন, “সফর মাসে এক লাখ বিশ হাজার বালা নাজিল হয় এবং সব দিনের চেয়ে বেশি আখেরি চাহার সোম্বা (সফর মাসের শেষ বুধবার) তে নাজিল হয়। সুতরাং ঐ দিনে যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত নিয়মে চার রাকআত নামাজ পড়বে আল্লাহ তাআলা তাঁকে ঐ বালা হতে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাঁকে হেফাজত রাখবেন…। [রাহাতুল কুলুব। পৃষ্ঠা নাম্বার: ১৩৯] এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, সফর মাসের শেষ বুধবারের কোনও প্রকার বিশেষত্ব হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এই দিনে ইবাদত, বন্দেগি, নামাজ, রোজা, জিকির, দুআ, দান-সদকা ইত্যাদি পালন করলে অন্য দিনের চেয়ে বেশি বা বিশেষ কোনও সওয়াব ও বরকত লাভ করা যাবে বলে ধারণা করা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। আল্লাহ আমাদের সকলকে সর্বপ্রকার বিদআত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
[সফর মাসে বর্জনীয় অংশটি নেওয়া হয়েছে: muslimsday থেকে]। আল্লাহু আলাম।
-আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি-