শিশুদের আত্মহত্যা

শিশুদের আত্মহত্যা: কিছু লোম হর্ষক ঘটনা এবং এর কারণ ও প্রতিকার
১২ বছরের শিশু আত্মহত্যা করলে সেও কি আখিরাতে জাহান্নামি হবে?
▬▬▬◍❂◍▬▬▬
প্রশ্ন: ১২ বছরের শিশু যদি আত্মহত্যা করে তাহলে কি সে জাহান্নামি হবে?
উত্তর:
জানা আবশ্যক যে, ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা করা কবিরা গুনাহ এবং জাহান্নামে এ জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে। (নিম্নে প্রদত্ব লিংকে এ বিষয়ে বিস্তারিত পড়ুন) তবে তা প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন (পাগল নয়) ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

অত:এব, কোনও অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু যদি আত্মহত্যা করে তাহলে আখিরাতে সে এ কারণে জাহান্নামি হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত বান্দার কোনও গুনাহ লিখেন না। যেমন: মা আয়েশা রা. সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثَةٍ: عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ، وَعَنِ المُبْتَلَى حَتَّى يَبْرَأَ، وَعَنِ الصَّبِيِّ حَتَّى يَكْبُرَ
“তিন ধরণের লোকের উপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। যথা:
❂ ১. ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ না জাগ্রত হয়,
❂ ২. অসুস্থ (পাগল) ব্যক্তি, যতক্ষণ না আরোগ্য লাভ করে এবং
❂ ৩. অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক, যতক্ষণ না প্রাপ্তবয়স্ক হয়।
[সুনান আবু দাউদ (তাহকিক কৃত) ৩৩/ অপরাধ ও তার শাস্তি, পরিচ্ছেদ: ১৬. পাগল চুরি বা হাদ্দযোগ্য অপরাধ করলে-সহিহ]
ফিকাহ বিশ্বকোষ এ এসেছে,
” التَّكْلِيفُ بِالْفَرَائِضِ وَالْوَاجِبَاتِ وَتَرْكِ الْمُحَرَّمَاتِ يُشْتَرَطُ لَهُ الْبُلُوغُ ، وَلاَ تَجِبُ عَلَى غَيْرِ الْبَالِغِ … وَلاَ يَجِبُ الْقِصَاصُ وَالْحُدُودُ ، كَحَدِّ السَّرِقَةِ وَحَدِّ الْقَذْفِ وَلَكِنْ يَجُوزُ أَنْ يُؤَدَّبَ ” انتهى .
“ফরজ ও ওয়াজিব পালন এবং হারাম বর্জনের বিধিবিধান প্রযোজ্য হওয়ার জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া শর্ত। সুতরাং তা অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের উপর প্রযোজ্য হবে না। অনুরূপভাবে তার উপর কেসাস তথা হত্যার কারণে মৃত্যুদণ্ড, চুরি, জিনার অপবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের জন্য হুদুদ (শরিয়া দণ্ডবিধি) প্রয়োগ করা যাবে না। তবে তাকে আদব শেখানো বৈধ।” [আল মাউসুআতুল ফিকহিয়া (ফিকাহ বিশ্বকোষ), ৮/১৯৬]
লক্ষণীয় বিষয় হল, ছেলে ও মেয়ে শিশুদের প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কিছু আলামত রয়েছে (যা সুপরিচিত)। সেগুলোর কোনও একটি পরিলক্ষিত হলে তখন তাকে ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা শিশু’ হিসেবে গণ্য করা হবে না। বরং তার উপর সাধারণ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের অনুরূপ বিধিবিধান প্রযোজ্য হবে।

❑ শিশুরাও কি আত্মহত্যা করে এবং কেন করে?

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) ‘শিশু অধিকার পরিস্থিতি ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, দেশে কিশোর-কিশোরী ও শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। ২০১৮ সালে ২৯৮টি শিশু আত্মহত্যা করেছে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২১৩। শিশুদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুদের আত্মহত্যার কারণগুলো হলো পারিবারিক কলহ, অভিমান, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, বাল্যবিবাহ, যৌন নির্যাতন-নিপীড়নের ও পর্নোগ্রাফির শিকার হওয়া, প্রেম-ভালোবাসায় ব্যর্থ বা প্রত্যাখ্যাত হওয়া এবং শৌখিন জিনিস কিনে না দেওয়া। [প্রথম আলো পত্রিকা]

উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে কারও বয়স ১৮ বছরের কম হলে তাকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ধরা হয় কিন্তু ইসলামি শরিয়ার আলোকে তা সঠিক নয়। বরং শিশুর মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার যে সব আলামত রয়েছে সেগুলোর কোনও একটি প্রকাশিত হলে অথবা ১৫ বছর বয়স হলে তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক বলে গণ্য করা হয়।

❑ শিশুদের আত্মহত্যার কিছু লোমহর্ষক ঘটনা:

১. “বাবার সঙ্গে অভিমান করে বাগেরহাটের চিতলমারীতে গলায় গামছা পেঁচিয়ে বলাই (১২) নামের এক শিশু আত্মহত্যা করেছে। চিতলমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর শরিফুল হক জানান, বাড়ির পাশে এক সামাজিক অনুষ্ঠানে যাবার কথা বললে পরীক্ষার জন্য তার বাবা তাকে বাধা দেয়। এতে সে রাগে ক্ষোভে নিজ ঘরে গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।” (dailyinqilab)

২. নেত্রকোনার দুর্গাপুরে গলায় গামছা পেঁচিয়ে ৫ম শ্রেণীর ছাত্র খাইরুল (১০) নামে এক শিশু আত্মহত্যা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।এ বিষয়ে দুর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহনুর-এ আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোনা মর্গে পাঠানো হয়েছে। কী কারণে শিশুটি আত্মহত্যা করেছে এ ব্যাপারে পরিবারের কাছ থেকে কিছুই জানা যায়নি।” (jugantor)

৩. মায়ের মৃত্যুর শোক সইতে না পেয়ে ১২ বছরের শিশু ফাতিমা আক্তার শনিবার সন্ধ্যায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। প্রায়ই একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকতো। পরিবারের লোকজন বুঝিয়ে তাকে মায়ের শোক ভোলাতে পারেনি।” (rtvonline)

৪. ফরিদপুরের সালথায় ২য় শ্রেণির ছাত্র ৭ বছরের শিশুর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। জুনায়েদের দাদি তছিরন বেগম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জুনায়েদ বদ মেজাজি ছিল। জুনায়েদর ফুফু নিলুফা জানান, জুনায়েদর ইচ্ছার বাইরে কোন কিছু করলেই ঘরের আসবাবপত্র নষ্ট করে ফেলতো। তবে এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি। [dailyinqilab]

৫. কুমিল্লা লাকসাম উপজেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ফয়সাল (১০) নামে এক শিশু গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পৌরশহরে ৫নং ওয়ার্ডে মিয়াপাড়া এলাকার দিনমজুর ইউনুস মিয়ার প্রথম সংসারে তিন ছেলে সন্তান রেখে স্ত্রী মারা যান। পরে ইউনুস মিয়া পারভীনকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ওই সংসারেও দুই ছেলে এক মেয়ে মধ্যে ফয়সাল বড়। শুক্রবার সন্ধ্যায় ইউনুস মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী পারভিন আক্তার ফয়সালকে একা ঘরে রেখে তার বাবারবাড়ি (পৌরসভার বাগবাড়ী) বেড়াতে যেতে চান। এসময় নানাবাড়িতে যাওয়ার বায়না করে ফয়সাল। এতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ফয়সালের কথা কাটাকাটি হয়। ফয়সালকে ঘরে একা রেখে বাবা-মা বেড়াতে চলে যায়। এতে অভিমান করে রাত সাড়ে ৮টার দিকে সবার অজান্তে নিজ ঘরে ফয়সাল ঘরের সিলিংয়ের সঙ্গে কাপড় পেঁচিয়ে ফাঁস দেয়। [jugantor]
এমন শত শত লোম হর্ষক ও হৃদয় বিদারক ঘটনা আমাদের সমাজে ঘটে চলেছে। আল্লাহ আমাদের শিশুদেরকে হেফাজত করুন। আমিন।

❑ আপনার সন্তানের মুখে এই কথাগুলো শুনলে অবশ্যই আপনার সতর্ক হওয়া দরকার:

“আমাকে কেউ ভালবাসে না!”
“আমার বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না!”
“আমি যখন থাকবো না…”
“আমি আর তোমাদের কারো জন্য সমস্যা হবো না!”
“এটা আমার প্রিয়, তবে কিছুদিন পর তুমি নিয়ে নিতে পারো!”
“এই দুনিয়া আমার জন্য না!”

❑ সন্তানের মাঝে নিমোক্ত বিষয় পরিলক্ষিত হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন:

– মাদকাসক্ত
– বারবার নিজেকে ক্ষতি করার প্রবণতাযুক্ত
– আত্মহত্যার হুমকি দিলে
– নিজের প্রিয় জিনিস সব বিলিয়ে দিলে
– বন্ধুদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেললে
– বারবার মৃত্যুর কথা বললে
– অকারণে কান্নাকাটি করলে
– সারাক্ষণ বিরক্ত বা হতাশ থাকলে
– ঘুম বা খাওয়ার সমস্যা হলে
– বুলিং বা যেকোন বড় মানসিক চাপের সম্মুখীন হলে
– সন্তান যদি বলে যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে চায়
যেহেতু শিশু-কিশোরদের অধিকাংশ সময় অভিভাবকদের সাথে অতিবাহিত হয়, তাই তারাই পারেন সবার আগে শিশুদের বিষণ্ণতা বা আত্মহত্যার ঝুঁকি নির্ধারণ করতে। সন্তানের আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্যারেন্টিংও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অভিভাবক হিসেবে আপনার সর্তকতা বাঁচাতে পারে আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ! অবশ্যই দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ, সন্তানের জন্য হতে পারে life-saving! [banglarkothamala]
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬◍❂◍▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: