রমজান মাসের প্রথম অংশ রহমত ও মধ্য অংশ মাগফিরাত এবং শেষাংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তি এ হাদিসটি কি সঠিক

উত্তর: এই সংক্রান্ত হাদিসটি আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে পরিচিত। এই কথাটি সেহেরি-ইফতারের সময়সূচী, রোজা-রমজান বিষয়ক বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকার ইসলামি কলাম ইত্যাদিতে উল্লেখ করা হয়ে তাকে, অনেক মসজিদের ইমাম, খতিব এবং ইসলামি বক্তাদের মুখেও প্রায় শোনা যায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তা ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়।

কিন্তু হাদিস বিশারদগণের দৃষ্টিতে তা সনদগতভাবে জয়িফ (দুর্বল) হওয়ার পাশাপাশি এর মমার্থও সমস্যাপূর্ণ। কেননা পুরা রমজান ব্যাপী আল্লাহর রহমত ও বরকত নাজিল হয়। এবং রমজানের প্রতিটি রাত্রেই জাহান্নামের আগুন থেকে অসংখ্য মানুষকে মুক্ত ঘোষণা করা হয় যে বিষয়ে হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
তাছাড়া রহমত, মাগফিরাত (ক্ষমা) ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি সবগুলোই একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কারণ আল্লাহ সীমাহীন রহমত বা দয়ার কারণেই তিনি বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন। আর যে তার ক্ষমা লাভ করে সেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে। সুতরাং এভাবে রমজানকে ভাগ করা সমীচীন নয়।

অতএব এই হাদিস প্রচার করা ঠিক নয়। এর পরিবর্তে রমজানের ফজিলতে যে সকল বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে সেগুলো প্রচার করা উচিত।

ইসলাম অনলাইন (islamonline)-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো:

◈ সালমান আল-ফারিসি (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবান মাসের শেষ দিনে আমাদের খুতবা দেন এবং বলেন:

أَيُّهَا النَّاسُ، قَدْ أَظَلَّكُمْ شَهْرٌ عَظِيمٌ مُبَارَكٌ، شَهْرٌ فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، جَعَلَ اللهُ صِيَامَهُ فَرِيضَةً، وَقِيَامَ لَيْلِهِ تَطَوُّعًا، مَنْ تَقَرَّبَ فِيهِ بِخَصْلَةٍ مِنَ الْخَيْرِ كَانَ كَمَنْ أَدَّى فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ، وَمَنْ أَدَّى فِيهِ فَرِيضَةً كَانَ كَمَنْ أَدَّى سَبْعِينَ فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ، وَهُوَ شَهْرٌ أَوَّلُهُ رَحْمَةٌ، وَأَوْسَطُهُ مَغْفِرَةٌ، وَآخِرُهُ عِتْقٌ مِنَ النَّارِ

‘হে মানুষ! তোমাদের ওপর ছায়া ফেলেছে এক মহান ও বরকতময় মাস। এ মাসে এক রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ এ মাসের রোজাকে ফরজ করেছেন এবং এর রাতের কিয়ামকে নফল ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। যে ব্যক্তি এতে কোনও নেক আমল দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে, সে যেন অন্য সময় ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এতে ফরজ আদায় করবে, সে যেন অন্য সময় সত্তরটি ফরজ আদায় করল। এটি এমন এক মাস, যার প্রথম অংশ রহমত, মধ্য অংশ মাগফিরাত এবং শেষ অংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তি…’”(হাদিসের সম্পূর্ণ অংশ এখানে উল্লেখ করা হয়নি।)

[বায়হাকির শুআবুল ইমানে হা/৩২১; কিতাবুদ দুয়াফা’ লিল উকাইলি: (২/১৬২); ‘আল-কামেল ফি দুয়াফায়ির রিজাল’ লি ইবনে আদি: (১/১৬৫); ‘কিতাবু ইলালিল হাদিস’ লি ইব্‌ন আবি হাতেম: (১/২৪৯); ‘সিলসিলাতিল আহাদিসুস দায়িফা ওয়াল মাওদুয়াহ’ হা/ ১৫৬৯]
________________________________________
◈ হাদিসের বিশুদ্ধতা:
এই হাদিসটি দীর্ঘ হাদিসের একটি অংশ, যা ইমাম ইবনে খুযাইমা, বায়হাকি ও তাবারানি রেওয়ায়ত করেছেন। তবে হাদিস বিশেষজ্ঞগণ এটিকে দুর্বল (ضعيف) বলেছেন।
________________________________________
◈ হাদিসটি কেন দুর্বল?

১. সনদের দুর্বলতা:

✅ এতে সাঈদ ইবনে মুসাইয়িব আছেন, যিনি সালমান ফারিসি (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে সরাসরি বর্ণনা করেননি। অর্থাৎ এখানে সনদের (ইসনাদের) সমস্যা রয়েছে।
✅ এছাড়া আলী ইবনে যায়দ ইবনে জুদআন নামে একজন বর্ণনাকারী আছেন, যিনি দুর্বল (ضعيف) হিসেবে চিহ্নিত।
________________________________________
২. মুহাদ্দিসদের মতামত:
✅ হাফিজ ইবনে হজর, ইমাম আহমদ, ইবনে মাইন, নাসাঈ, ইবনে খুযাইমা, জাওযাজানি প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এটিকে দুর্বল বলেছেন।
✅ আবু হাতিম রাযি, ইমাম আইনি ও শায়খ আলবানি এটিকে “মুনকার” (আপত্তিজনক এবং অগ্রহণযোগ্য) বলেছেন।
________________________________________
৩. বিষয়বস্তুর সমস্যা:

✅ হাদিসটিতে রমজানের রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির বিষয়টিকে তিন দশকে ভাগ করা হয়েছে। অথচ আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তি সারা মাসব্যাপী বর্ষিত হয়।
✅ সহিহ হাদিস অনুসারে, রমজানের প্রথম রাত থেকেই জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়।
________________________________________
◈ সহিহ হাদিস থেকে প্রমাণ:

ইমাম তিরমিজি [হাসান] হাদিসে আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত:

إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتْ الشَّيَاطِينُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ ، وَفُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ ، وَيُنَادِي مُنَادٍ يَا بَاغِيَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ ، وَلِلَّهِ عُتَقَاءُ مِنْ النَّارِ وَذَلكَ كُلُّ لَيْلَةٍ

“যখন রমজানের প্রথম রাত হয়, শয়তান ও বিদ্রোহী জিনদের শৃঙ্খলিত করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কোনও দরজা খোলা হয় না, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং কোনও দরজা বন্ধ করা হয় না। একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেন: ‘হে কল্যাণ প্রত্যাশী! এগিয়ে আসো। হে মন্দ প্রত্যাশী! বিরত থাকো।’ এবং আল্লাহ অনেককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, যা প্রতি রাতেই ঘটে।” [তিরমিজি: ৬৮২, হাসান]

◈ সতর্কতা:

দাঈদের (প্রচারকদের) উচিত এই হাদিসের দুর্বলতার বিষয়টি জানা এবং আল্লাহর রহমতকে নির্দিষ্ট দশকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পুরো রমজান ব্যাপী আল্লাহর রহমত ও মুক্তির ব্যাপকতা তুলে ধরা।
সহিহ হাদিস অনুসারে, রমজানের শুরু থেকেই জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাই রমজানকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যথার্থ নয়।

❑ আল্লামা শাইখ ফাউযান (হাফিযাহুল্লাহ):

বর্তমান জমানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ, আল্লামা শাইখ ফাউযান (হাফিযাহুল্লাহ) কে প্রশ্ন করা হয়, কিছু মানুষ রমজান মাস এলে বলে থাকে: “রমজানের প্রথম অংশ রহমত, মধ্য অংশ মাগফিরাত আর শেষ অংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তি।” এটি কি কোনও হাদিস বা আসার?

উত্তরে তিনি বলেন,

هذا أثر يُنسب إلى النبي صلى الله عليه وسلم، ولكنه ضعيف الإسناد. سمعت شيخنا، الشيخ ابن باز -رحمه الله- يقول: “رمضان كله تجتمع فيه هذه الثلاث: الرحمة، والمغفرة، والعتق من النار، من أوله إلى آخره، من غير هذا التفصيل.”

“এটি একটি আসার হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি সম্বন্ধ করা হয়। তবে এর সনদ দুর্বল। আমি আমাদের শ্রদ্ধেয় শাইখ, শাইখ ইবনে বাজ (রহিমাহুল্লাহ)-কে বলতে শুনেছি: “রমজানের সম্পূর্ণ মাস জুড়ে এই তিনটি (রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি) একত্রে বিদ্যমান থাকে কোনও নির্দিষ্ট বিভাজন ছাড়াই।” [শাইখ সালিহ বিন ফাওজান আল ফাওজান (হাফিযাহুল্লাহ)-এর ভিডিও থেকে অনুদিত]
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: