যে দশটি শর্তসাপেক্ষে ম্যান পাওয়ার সাপ্লাই বিজনেস বা জনশক্তি সরবরাহ ব্যবসা হালাল

প্রশ্ন: একজন ব্যক্তি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করে। যখন কাজের প্রচুর চাপ থাকে তখন তিনি কোম্পানির আদেশে কিছু দক্ষ-অদক্ষ লোক দিয়ে হাজিরা হিসেবে কাজ করান। তাদের সবাইকে তিনি কত টাকা করে করে হাজিরা দিবেন তা আগেই চুক্তি করে নেন কিন্তু কোম্পানি থেকে তিনি জন প্রতি ৫০ টাকা করে বেশি নেন এবং এই কমিশন টাকাটা তিনি নিজে রাখেন। তার এই টাকাটি কি হালাল না হারাম? (নোট: লোকটির মতে, তিনি যেহেতু হাজিরা লোকদের পিছনে পরিশ্রম করেন, তাদেরকে কাজ বুঝানো, পরিচালনা ইত্যাদি করেন সেহেতু তার এই কমিশন নেওয়াটা হালাল।)
উত্তর: এটিকে ‘ম্যান পাওয়ার সাপ্লাই বিজনেস (Manpower supply business) বা জনশক্তি সরবরাহ ব্যবসাও বলা হয়।

❑ ম্যান পাওয়ার সাপ্লাই ব্যবসা কী?

ম্যান পাওয়ার সাপ্লাই বা জনশক্তি সরবরাহ ব্যবসা হলো, এমন একটি ব্যবসা যেখানে বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী কর্মী বা শ্রমিক সরবরাহ করা হয়। এটি মূলত একটি হিউম্যান রিসোর্স (HR) ও (লেবার সাপ্লাই) ভিত্তিক ব্যবসা, যেখানে কোম্পানিগুলো তাদের প্রয়োজনীয় কর্মী পেতে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেয়। এই ব্যবসায় ম্যান পাওয়ার সাপ্লায়ার বা জনশক্তি সরবরাহকারী ব্যক্তি বা সংস্থা বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে এই মর্মে চুক্তি করে যে, সে তাদেরকে মাসিক, দৈনিক বা ঘণ্টা প্রতি এত টাকা হারে শ্রমিক দিবে। অতঃপর সে শ্রমিকের সাথে তার থেকে কম মূল্যে চুক্তি করে। অতঃপর চুক্তি মোতাবেক সে কোম্পানির নিকট শ্রমিক সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে জনশক্তি বা শ্রমিক সরবরাহকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মধ্যস্বত্ব ভোগী হিসেবে কিছু মুনাফা অর্জন করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে এ ব্যবসায় কোনও সমস্যা নাই। অর্থাৎ এ ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা হালাল। কারণ তা কোম্পানি বা প্রকল্পের কাজের জন্য শ্রমিক সংগ্রহ করা, প্রয়োজন পথে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, কোম্পানি এবং শ্রমিকদের মাঝে মধ্যস্থতা করা, শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, তাদেরকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া ও পরিচালনা ইত্যাদি পরিশ্রমের বিনিময়ে উপার্জন।

তবে এ ক্ষেত্রে কতিপয় শর্ত এবং বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এগুলো যথাযথভাবে পূরণ করা হলে তা হালাল; অন্যথায় তা হারামে পরিণত হবে।

নিচে এ মর্মে দশটি শর্ত উল্লেখ করা হলো:

❂ ১. হালাল বা বৈধ শ্রম:

শ্রমটা ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল এবং সরকারি আইনে বৈধ হওয়া। (যেমন— নির্মাণ, কৃষি, শিল্প ইত্যাদি)

সুতরাং কোনও হারাম বা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ বা আইন বহির্ভূত ভাবে কোন কাজ (দেহব্যবসা, মদ তৈরি বা পরিবেশন, সুদ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, সরকারের অনুমোদন বিহীন ব্যবসা ইত্যাদি)-এর জন্য শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া, কোম্পানি ও শ্রমিকদের মাঝে মধ্যস্থতা করা এবং এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা ইত্যাদি সবই হারাম।

❂ ২. স্বচ্ছ চুক্তি:

– শ্রমিক, সরবরাহকারী, এবং নিয়োগকর্তার মধ্যে স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত চুক্তি থাকা।
কাজ শুরু করার পূর্বে শ্রমিককে তার কাজের ধরণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানানো।
– কর্মঘন্টা তথা কাজের সময়-সীমা (প্রতিদিন কত ঘণ্টা এবং শুরু ও শেষ সময়) নির্ধারণ করা।
– শ্রমিকদের ওভার টাইম, ছুটি, কাজের মধ্যে খাবার, সালাত, বিশ্রাম ইত্যাদির জন্য বিরতি ইত্যাদি নীতিমালা আগেই নির্ধারণ করা।
– স্যালারি বা পারিশ্রমিকের পরিমাণ নির্ধারণ করা ইত্যাদি।

❂ ৩. চুক্তি বাস্তবায়ন:

শ্রমিকদের সাথে কৃত চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনও চুক্তি লঙ্ঘন করা যাবে না। ইসলামের চুক্তি রক্ষা করার ব্যাপারে অপরিসীম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এখনো চুক্তির লঙ্ঘনকে মারাত্মক অপরাধ ও গুনাহ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

তবে জরুরি প্রয়োজনে শ্রমিকের সাথে কথা বলে বা তার সম্মতিক্রমে চুক্তির বিশেষ কোনও ধারা পরিবর্তন বা সংশোধন করা যেতে পারে।

❂ ৪. চুক্তি মোতাবেক যথাসময়ে পারিশ্রমিক/বেতন পরিশোধ:

চুক্তিতে উল্লেখিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোন ধরনের টালবাহানা বা ছলচাতুরি ব্যতিরেকে শ্রমিকের নিকট তার পারিশ্রমিক/বেতন পরিশোধ করতে হবে।

‘কোম্পানি থেকে স্যালারি আসেনি বা প্রকল্প থেকে লাভ হয়নি বা ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে এসব বলে সরবরাহকারী শ্রমিকদের পাওনা আদায়ে বিলম্ব বা গড়িমসি করতে পারবে না। কোম্পানি থেকে স্যালারি পেতে দেরি হলে কিংবা কোম্পানি টাকা না দিলে অথবা কন্টাক্টর বা শ্রমিক সরবরাহকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে চুক্তি মোতাবেক সে তার নিজস্ব পূঁজি থেকে বেতন পরিশোধ করবে। কারণ সে শ্রমিকের সাথে নির্দিষ্ট সময়ে বেতন সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ। শ্রমিকের সম্মতি ব্যতিরেকে সে তাকে এক পয়সাও কম দেওয়ার অধিকার রাখে না।

❂ ৫. শ্রমিকদের সাথে মিথ্যা কথা বলা,‌ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও ধোঁকাবাজি করা হারাম। যেমন: নির্ধারিত কাজের কথা বলে নিয়োগ দেওয়ার পরে অন্য কাজ করতে বাধ্য করা, নির্দিষ্ট বেতন থেকে কম দেওয়া, কাজ শেষে বোনাস দেওয়ার কথা বলে না দেওয়া ইত্যাদি।

❂ ৬. টাইম শীট (Timesheet বা কর্মঘন্টা) ক্রয়-বিক্রয়:

টাইম শীট ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। উদাহরণ: শ্রমিকের নিকট তার কাজের টাইম শীট কম টাকায় ক্রয় করে পরবর্তীতে কোম্পানি থেকে এর মাধ্যমে বেশি টাকা উত্তোলন করা। এটা সুদের অন্তর্ভুক্ত।

❂ ৭. জোরপূর্বক শ্রম:

শ্রমিকদের ইচ্ছার বাইরে জোরজবরদস্তি মূলক বা অমানবিক কাজে নিয়োগ দেওয়া বা সাধ্যাতীত কোনও কাজে বাধ্য করা জায়েজ নয়। কেননা তা জুলুম। আর ইসলামে জুলুম করা কবিরা গুনাহ।

অনুরূপভাবে যদি কাউকে বাধ্য করা হয় এমন চুক্তিতে যেখানে তারা স্বাধীনভাবে কাজ ছাড়তে পারে না তাহলে তা ইসলামি আইনে যেমন হারাম তেমনি দেশের আইনেও দণ্ডনীয় অপরাধ।

❂ ৮. শ্রমিকদেরকে তাদের প্রাপ্য দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে গড়িমসি করা বা বিলম্ব করা হারাম‌‌।

❂ ৯. ঘুষ, দুর্নীতি অথবা রাজনৈতিক বা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে কাজ ধরা। এটা অন্যায় এবং হারাম।

❂ ১০. কোম্পানি বা প্রকল্প পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত শ্রমিকের রিকোয়ারমেন্ট” (Requirement) তথা আবশ্যকীয় শর্ত ও যোগ্যতা পূরণের ক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজের অনুমোদন পত্র, পরিচয় পত্র, সনদপত্র, সরকারি বিভিন্ন ডকুমেন্ট ইত্যাদিতে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া অথবা তাদেরকে এক্ষেত্রে সাহায্য করা হারাম।

মোটকথা, যদি ন্যায়সঙ্গত ও নৈতিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে ‘ম্যান পাওয়ার সাপ্লাই’ ব্যবসা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ। কিন্তু যদি এতে অন্যায়, প্রতারণা, জুলুম বা হারাম উপার্জন জড়িত থাকে তবে এটি হারাম হবে।
আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন। আল্লাহ আলাম।
▬▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: