প্রশ্ন: যারা ভাষার জন্য নিহত হয়েছেন তাদেরকে ইসলামের দৃষ্টিতে ‘শহিদ’ বলা যাবে কি?
উত্তর: ‘শহিদ’ একটি ইসলামি পরিভাষা। সুতরাং এটি ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিষয়। ইসলামের শহিদের মর্যাদা অতুলনীয়। শহিদ মৃত্যুবরণ করার সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতের নিয়ামত ভোগ করতে থাকেন।
এটি কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিভাষা নয়। তাই ইসলামের নির্ধারিত সংজ্ঞা ছাড়া অন্য কোনো প্রসঙ্গে এই শব্দটি ব্যবহার করা উচিত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে তাকেই শহিদ বলা হয়, যিনি একমাত্র আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে জিহাদ করতে করতে নিহত হন।
সুতরাং কেউ যদি শুধু দেশ, ভাষা, আঞ্চলিকতা, রাজনৈতিক স্বার্থ, বংশগত আভিজাত্য কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশে যুদ্ধ বা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে নিহত হন, তবে তিনি শহিদ হবেন না।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের সমাজে এই মর্যাদাপূর্ণ বিশেষণটি রাজনৈতিক স্বার্থে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নাস্তিক যে কারও জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে!
❑ কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে শহিদের পরিচয় ও মর্যাদা:
◈ আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَٰكِنْ لَا تَشْعُرُونَ
“আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা অনুভব করতে পারো না।” [সূরা বাকারা: ১৫৩]
◈ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:
فَلْيُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يَشْرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآخِرَةِ ۚ وَمَنْ يُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا
“কাজেই যারা পার্থিব জীবনকে আখিরাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়, তাদেরই আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা উচিত। বস্তুত যারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে এবং অতঃপর মৃত্যুবরণ করে কিংবা বিজয় অর্জন করে, আমি তাদেরকে বিশাল প্রতিদান দান করব।” [সূরা নিসা: ৭৪]
◈ হাদিসের ভাষায় শহিদ:
عن أبي موسى قال : جاء رجل إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال : الرجل يقاتل للمغنم والرجل يقاتل للذكر والرجل يقاتل ليرى مكانه فمن في سبيل الله ؟ قال : ” من قاتل لتكون كلمة الله هي العليا فهو في سبيل الله”
আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “এক ব্যক্তি গণিমতের সম্পদ অর্জনের জন্য জিহাদ করল, একজন নিজের সুনামের জন্য জিহাদ করল, আরেকজন তার বীরত্ব দেখানোর জন্য যুদ্ধ করল। এদের মাঝে কে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করল?”
রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানকে উচ্চকিত করতে যুদ্ধ করল, সে-ই কেবল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করল।” [সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২৬৫৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৫০২৯]
❂ ইসলামের দৃষ্টিতে আরও যারা শহিদের অন্তর্ভুক্ত:
রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
من قتل دون ماله فهو شهيد ومن قتل دون أهله أو دون دمه أو دون دينه فهو شهيد
• যে ব্যক্তি নিজ সম্পত্তি রক্ষায় নিহত হয়, সে শহিদ।
• যে ব্যক্তি নিজ পরিবার রক্ষায় নিহত হয়, সেও শহিদ।
• যে ব্যক্তি প্রাণ রক্ষায় কিংবা দ্বীন রক্ষায় নিহত হয় সেও শহিদ।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৭৭৪; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-১৬৫২)
❂ আরও কতিপয় ব্যক্তি যারা শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবেন:
রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
الشهداء سبعة سوى القتل في سبيل الله المطعون شهيد والغرق شهيد وصاحب ذات الجنب شهيد والمبطون شهيد والحرق شهيد والذي يموت تحت الهدم شهيد والمرأة تموت بجمع شهيد
“আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও সাত প্রকার শহিদ রয়েছে। যথা:
১. প্লেগ বা মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী শহিদ।
২. পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারী শহিদ।
৩. ফুসফুসের রোগে (প্লুরিসি) মৃত্যুবরণকারী শহিদ।
৪. পেটের রোগে মৃত্যুবরণকারী শহিদ।
৫. অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী শহিদ।
৬. দেয়াল বা ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণকারী শহিদ।
৭. সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুবরণকারী নারীও শহিদ।” [মুয়াত্তা মালিক, হাদিস নং-৫৫৪, ৮০২; আল-মু’জামুল কাবীর, হাদিস নং-১৭৮০; সহিহ কুনুজুস সুন্নাহ, হাদিস নং-২৩]
❑ কাউকে নির্দিষ্টভাবে শহিদ বলা জায়েজ নাই:
আল্লাহ এবং তাঁর রসুল যাদেরকে নির্দিষ্টভাবে শহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তাদেরকে ছাড়া আর কোন মানুষকে নির্দিষ্ট করে শহিদ বলা জায়েজ নাই। সে যেই হোক না কেন। এমনকি জিহাদে কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে মারা গেলেও তাদেরকে নির্দিষ্টভাবে শহিদ বলা বৈধ নয় যে, উমুক, উমুক শহিদ। কারণ আমি-আপনি জানি না সে কী নিয়তে জিহাদ করেছে। আল্লাহর দ্বীনের জন্য নাকি মানুষ তাকে বীর যোদ্ধা বা সহাসী মুজাহিদ বলবে সে জন্য।
তবে কোনও ব্যক্তির বাহ্যিক অবস্থার প্রতি সুধারণা রেখে তা জন্য দুআ করা যাবে যে, আল্লাহ তাকে শহিদ হিসেবে কবুল করুন। অথবা আশা করা যায়, যে সে আখিরাতে শহিদি মর্যাদা লাভ করবে। অথবা আমভাবে বলা যাবে যে, যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে তারা শহিদ. যারা এই এই করবে তারা শহিদ। কিন্তু নাম ধরে নির্দিষ্টভাবে নয়। ইমাম বুখারি এভাবে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন যে,
باب لا يقال: فلان شهيد
”একথা বলা যাবে না যে, অমুক ব্যক্তি শহিদ।”
ইবনে হাজার আসকালানি রাহ. বলেন,
: أي على سبيل القطع بذلك إلا إن كان بالوحي، وكأنه أشار إلى حديث عمر أنه خطب فقال: تقولون في مغازيكم فلان شهيد ومات فلان شهيداً ولعله قد يكون قد أوقر راحلته. ألا لا تقولوا ذلكم ولكن قولوا كما قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من مات في سبيل الله أو قتل فهو شهيد. وهو حديث حسن أخرجه أحمد وسعيد بن منصور وغيرهما من طريق محمد بن سيرين … وعلى هذا فالمراد النهي عن تعيين وصف واحد بعينه بأنه شهيد، بل يجوز أن يقال ذلك على طريق الإجمال. انتهى
অর্থাৎ ওহির মাধ্যমে অবগত হওয়া ব্যতীত অকাট্য ভাবে কারও জন্য শহিদ হওয়ার ফায়সালা দেওয়া যাবে না। তিনি (ইমাম বুখারি রাহ.) সম্ভবত উমর রা. এর একটি ভাষণের দিকে ইংগিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “তোমরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে বলে থাক, অমুক ব্যক্তি শহিদ, অমুক ব্যক্তি শহিদ হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। কিন্তু হতে পারে সে তার বাহনে আরোহন করেছে, ব্যবসার উদ্দেশ্যে।
খবরদার! এভাবে বলো না বরং তোমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মতো বল যে, “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যু বরণ করল অথবা জীবন দিল সে শহিদ।” [মুসনাদ আহমদ-হাসান]
এ কথার ভিত্তিতে ইমাম বুখারির অনুচ্ছেদ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কাউকে নির্দিষ্টভাবে শহিদ উপাধিতে ভূষিত করা নিষিদ্ধ। তবে অনির্দিষ্টভাবে তা বলা জায়েজ।” [ফাতহুল বারি ৬/৯০] আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬
উত্তর প্রদান করেছেন:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যান্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।