নুআইম বিন হাম্মাদ রহ. এবং তার রচিত কিতাবুল ফিতান: একটি মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা

প্রশ্ন: ‘কিতাবুল ফিতান’ (ফিতনা-ফ্যাসাদ) এর রচয়িতা ইমাম নুয়াইম বিন হাম্মাদ রহ. সম্পর্কে জানতে চাই। আর এই কিতাবটি কি সহিহ?

উত্তর:

নুয়াইম বিন হাম্মাদ এর পুরো নাম হল, আবু আব্দিল্লাহ নুআইম বিন হাম্মাদ আল মারওয়াযি রহ. (মৃত্যু: ২২৮ হিজরি)। তিনি হাদিসের হাফেজ এবং অনেক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি প্রচুর বই-পুস্তক রচনা করেছেন।

তার ব্যাপারে ইমাম আহমদ বলেন:
كان في بداية أمره جهمياً، فعرف مذهبهم ثم طلب الحديث
“তিনি প্রথম পর্যায়ে জাহমিয়া (আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকারকারী বাতিল সম্প্রদায়ের অনুসারী) ছিলেন। পরে তাদের মতবাদ সম্পর্কে জানতে পেরে হাদিস অন্বেষণ শুরু করেন।”

◍◯◍ নুআইম বিন হাম্মাদ এর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের বক্তব্য:

তার গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে পূর্ববর্তী বড় আলেমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন। কেউ তাকে ‘নির্ভরযোগ্য’ আর কেউ ‘অ নির্ভরযোগ্য’ বলেছেন।

নিম্নে তার ব্যাপারে এগারো জন জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ইমামদের মতামত ও মূল্যায়ন তুলে ধরা হল:

◈ ১. বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম সালিহ জাযারা বলেন:
كان يحدث من حفظه، ولديه مناكير كثيرة لا يتابع عليها، سمعت يحيى بن معين سئل عنه فقال: ليس في الحديث بشئ، ولكنه صاحب سنة
“তিনি (নুয়াঈম বিন হাম্মাদ) মুখস্থ হাদিস বর্ণনা করতেন কিন্তু তার এমন প্রচুর ‘মুনকার’ (মারাত্মক দুর্বল ও আপত্তি জনক) বর্ণনা আছে যেগুলোর ‘মুতাবাআত’
পাওয়া যায় না।

◈ ২. বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইয়ায়হা ইবনে মাঈনকে তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে আমি তাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: “তিনি (নুয়াইম বিন হাম্মাদ) হাদিসের ক্ষেত্রে কিছুই নন। তবে তিনি সুন্নতের অনুসারী।”

◈ ৩. আবু আলি নিশাপুরি বলেন,
سمعت النسائي يذكر فضل نعيم بن حماد وتقدمه في العلم والمعرفة والسنن ، ثم قيل له في قبول حديثه فقال: قد كثر تفرده عن الأئمة المعروفين بأحاديث كثيرة ، فصار في حد من لا يحتج به
“আমি ইমাম নাসায়ীকে নুয়াইম বিন হাম্মাদ এর মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করতে এবং তাকে জ্ঞান-গরিমা ও সুন্নতের ক্ষেত্রে তার অগ্রগামিতার কথা বলতে শুনেছি। অত:পর তার বর্ণনা কৃত হাদিসগুলো গ্রহণ করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তিনি প্রসিদ্ধ ইমামদের থেকে এমন অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন যেগুলোর ক্ষেত্রে তিনি একক (তার বর্ণনাকে সমর্থনকারী অন্য কেউ নাই)। ফলে এমন একটা পর্যায়ে গেছে যে, তাকে দ্বারা দলিল পেশ করা যায় না।”
◈ ৪. ইমাম আবু দাউদ বলেন:
عند نعيم نحو عشرين حديثا عن النبي صلى الله عليه وسلم ليس لها أصل
“নুআইম এর নিকট নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত এমন বিশটি হাদিস আছে যেগুলোর কোন ভিত্তি নেই।

◈ ৫. ইবনে আদি তার কিছু মুনকার হাদিস পেশ করার বলেন:
له غير ما ذكرت وقد أثنى عليه قوم وضعفه قوم . “تهذيب التهذيب” (10/ 461)
“যেগুলো উল্লেখ করলাম সেগুলো ছাড়া তার বর্ণিত আরও মুনকার (মারাত্মক দুর্বল ও আপত্তি জনক) হাদিস আছে। একদল হাদিস বিশারদ তার ব্যাপারে প্রশংসা করলেও অন্যদল তাকে জঈফ (দুর্বল) বলেছেন। (তাহযিবুত তাহযিব ১০/৪৬১)

◈ ৬. হাফেজ ইবনে রজব রহ. বলেন:
نُعَيْمٌ هَذَا ، وَإِنْ كَانَ وَثَّقَهُ جَمَاعَةٌ مِنَ الْأَئِمَّةِ ، فَإِنَّ أَئِمَّةَ الْحَدِيثِ كَانُوا يُحْسِنُونَ بِهِ الظَّنَّ ، لِصَلَابَتِهِ فِي السُّنَّةِ ، وَتَشَدُّدِهِ فِي الرَّدِّ عَلَى أَهْلِ الْأَهْوَاءِ، وَكَانُوا يَنْسُبُونَهُ إِلَى أَنَّهُ يهِمُ، وَيُشَبَّهُ عَلَيْهِ فِي بَعْضِ الْأَحَادِيثِ ، فَلَمَّا كَثُرَ عُثُورُهُمْ عَلَى مَنَاكِيرِهِ، حَكَمُوا عَلَيْهِ بِالضَّعْف
“এই ‍নুআইম-যদিও একদল ইমাম তাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন-কেননা সুন্নাহর প্রতি দৃঢ়তা এবং বেদাতিদের জবাবে তার কঠোর অবস্থানের কারণে হাদিসের ইমামগণ তার প্রতি সুধারণা রাখতেন-কিন্তু তার প্রতি এ অভিযোগ করেছেন যে, তিনি হাদিসের ক্ষেত্রে ধারণা প্রসূত কথা বলতেন আর কিছু হাদিস তার কাছে তালগোল লেগে গিয়েছিলো।
যাহোক যখন তার তার কাছে বেশ কিছু মুনকার (মারাত্মক দুর্বল ও আপত্তি জনক) হাদিস পাওয়া গেলো তখন তারা তাকে জঈফ বা দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করলেন।”

◈ ৭. আবু যুরআ দিমাশকী বলেন:
يَصِلُ أَحَادِيثَ يُوقِفُهَا النَّاسُ ، يَعْنِي أَنَّهُ يَرْفَعُ الْمَوْقُوفَاتِ
“তিনি মাউকুফ হাদিস (সাহাবিদের কথা) কে মারফু তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা বলে বর্ণনা করতেন।”

◈ ৮. আবু আরূবা আর হাররানী বলেন:
هُوَ مُظْلِمُ الْأَمْرِ
“তার বিষয়টি অন্ধকারাচ্ছন্ন।”

◈ ৯. আবু সাঈদ বিন ইউনুস বলেন:
رَوَى أَحَادِيثَ مَنَاكِيرَ عَنِ الثِّقَاتِ، وَنَسَبَهُ آخَرُونَ إِلَى أَنَّهُ كَانَ يَضَعُ الْحَدِيثَ ” انتهى “جامع العلوم والحكم” (2/ 394)
“তিনি নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিসদের নিকট থেকে মুনকার (মারাত্মক পর্যায়ের দুর্বল) হাদিসে বর্ণনা করেছেন। আর অন্যরা তো তার প্রতি এ অভিযোগ করেছে যে, তিনি হাদিস বানাতেন।”। (জামেউল উলুম ওয়াল হিকাম ২/৩৯৪)

◈ ১০. ইমাম যাহাবী তার পক্ষে-বিপক্ষে মুহাদ্দিসগণের মতামতগুলো উল্লেখ করার পর বলেন:
من كبار أوعية العلم، لكنه لا تركن النفس إلى رواياته
“তিনি ইলমের বিরাট ধারক-বাহক হলেও তার বর্ণনাগুলোর প্রতি মনস্থির হয় না।” (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা: ১০/৬০০)

◈ ১১. ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ তার ব্যাপারে বলেন:
صدوق، يخطئ كثيرًا، فقيه، عارف بالفرائض
“তিনি সত্যবাদী ছিলেন কিন্তু প্রচুর ভুল করতেন। তিনি একজন ফকিহ এবং ইলমে ফারায়েজ তথা সম্পদ বণ্টন শাস্ত্র সম্পর্কে ভালো জানতেন।” (তাকরিবুত তাহযিব/ ৭২১৫)

উল্লেখ্য যে, আমরা উল্লেখ করেছি, নুআইম বিন হাম্মাদ রহ. একজন হাফেজে হাদিস ও বড় আলেম ছিলেন। এতে কোনো সন্দেহ নাই। তাকে অনেক মুহাদ্দিস সিকাহ বা বিশ্বস্ত বলেছেন এবং বুখারী ও মুসলিম সহ অনকে মুহাদ্দিস তার বর্ণিত হাদিস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তার নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করলেই তার সব কিছু গ্রহণযোগ্য হবে তা ঠিক নয়। কেননা হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সত্যবাদিতা, হাদিস সংরক্ষণ ও বিশ্বস্ততার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: ইমাম বুখারী রহ. এ দিক বিবেচনায় কিছু শিয়া থেকেও হাদিস বর্ণনা করেছেন। (যদিও তারা গোঁড়া রাফেযি ছিল না)।
হাফিজ ইবনে হাজার هدي الساري হাদিউস সারী গ্রন্থে أسماء جميع من وُسِموا بالتشيع من رواة البخاري “বুখারীর বর্ণনাকারীদের মধ্যে যাদেরকে শিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে” তাদের সবার নাম আলাদাভাবে জমা করেছেন।

মোটকথা, অনেক মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে তিনি যেহেতু অগ্রহণযোগ্য ও দুর্বল-এমনকি তার বিরুদ্ধে হাদিস বানানোরও অভিযোগ পাওয়া গেছে (যেমনটি ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে) সেহেতু তার বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করার ক্ষেত্রে খুব সচেতন হতে হবে এবং সে বিষয়ে অন্যান্য প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসদের তাহকিক দেখতে হবে। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।

❑ কিতাবুল ফিতান (কিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত বিভিন্ন ফিতনা-ফ্যাসাদ সম্পর্কিত গ্রন্থ) সম্পর্কে:
নুয়াঈম বিন হাম্মাদ কর্তৃক রচিত প্রসিদ্ধি কিতাবুল ফিতান বইটি ব্যাপারে ইমাম যাহাবী বলেন:
قلت لا يجوز لأحد أن يحتج به، وقد صنف كتاب (الفتن) فأتى به بعجائب ومناكير
“আমি বলি, তার কথা দিয়ে দলিল পেশ করা কারো জন্য বৈধ নয় তিনি আল ফিতান নামক গ্রন্থ রচনা করেছেন কিন্তু সেখানে তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত এবং প্রতিবাদ যোগ্য বিভিন্ন বিষয় এনেছেন।” সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১০/৬০৯)

আমার সামান্য গবেষণায় এতটুকুই এসেছে। যদি কোথাও ভুল হয় আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আর বিজ্ঞ পাঠক মণ্ডলীর নিকট অনুরোধ থাকবে, কোথাও অসঙ্গতি থাকলে দয়া করে সংশোধনী দিলে কৃতার্থ থাকব ইনশাআল্লাহ। জাযাকুমুল্লাহ খাইরান।
والله أعلــــــــــــــــم بالصــــــواب
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার।

Share: