প্রশ্ন: কোনও ব্যক্তি যদি অন্যায়ভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করে তাহলে সে কি শহিদ হিসেবে গণ্য হবে? অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করার ভয়াবহতা কতটুকু? পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম কে হত্যাকাণ্ডের সূচনা করেছিলো এবং তার পরিণতি কী হবে?
উত্তর:
নিন্মে উপরোক্ত প্রশ্নসমূহের সংক্ষেপে উত্তর প্রদান করা হল: و بالله التوفيق
🌀 ক. কোনও ব্যক্তি যদি অন্যায়ভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করে তাহলে সে কি শহিদ হিসেবে গণ্য হবে?
হ্যাঁ, যে ব্যক্তি বিনা অপরাধে অন্যায়ভাবে নির্যাতিত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে সে আখিরাতে আল্লাহর নিকট শহিদি মর্যাদা লাভ করবে। কেননা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضي الله عنه قَالَ : صَعِدَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِلَى ” أُحُدٍ ” وَمَعَهُ أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ وَعُثْمَانُ فَرَجَفَ بِهِمْ ، فَضَرَبَهُ بِرِجْلِهِ ، قَالَ : (اثْبُتْ أُحُدُ ، فَمَا عَلَيْكَ إِلاَّ نَبِيٌّ ، أَوْ صِدِّيقٌ ، أَوْ شَهِيدَان- رواه البخاري
আনাস বিন মালিক রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম আবু বকর রা. উমর রা. ও উসমান রা. সহকারে ওহুদ পাহাড়ে উঠলে তা প্রকম্পিত হয়ে উঠে। তখন তিনি পাহাড়ের গায়ে পদাঘাত করে বললেন:
“হে ওহুদ, তুমি স্থির হও। কারণ তোমার উপরে আছে একজন নবী, একজন সিদ্দীক এবং দু জন শহিদ।” (সহিহ বুখারী হা/ ৩৪৮৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম আল্লাহর ওহির মারফতে অগ্রিম ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, সে দিন ওহুদ পাহাড়ে তাঁর সাথে থাকা তিন জন অতি সম্মানিত সাহাবীর মধ্যে দু জন শহিদ হবেন।
ইতিহাস সাক্ষী, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সালাম এর ভবিষ্যতবাণী সত্যে পরিণত হয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এর তিরোধানের পর মুসলিম জাহানের ২য় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. ফজর সালাতে ইমামতি করা অবস্থায় আবু লুলু নামক এক অগ্নিপূজক ঘাতক কর্তৃক পেছন থেকে অতর্কিত বর্শাঘাতে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। আর ৩য় খলিফা উসমান বিন আফফান রা. তাঁর খিলাফতকালে একদল খারেজী বিদ্রোহী জঙ্গিদের হাতে মাজলুম অবস্থায় শাহাদত বরণ করেন। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন। আমীন।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শহিদি মর্যাদা লাভের জন্য শর্ত হল, ইমানদার হওয়া এবং ঈমানের মৌলিক দাবী পূরণ করা। যেমন: তাওহীদের উপর চলা, শিরক থেকে দূরে থাকা, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা, মানুষের হক নষ্ট না করা ইত্যাদি।
🌀 খ. অন্যায়ভাবে রক্তপাত ও হত্যা করার কঠিন পরিণতি:
ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়ভাবে রক্তপাত করা বা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা অত্যন্ত ভয়াবহ অপরাধ। এ মর্মে কুরআন ও হাদিসে পর্যাপ্ত আলোচনা এসেছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি আয়াত ও হাদিস তুলে ধরা হল:
▪ ১) আল্লাহ তাআলা ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া মানব হত্যার ভয়াবহ পরিণতিত কথা ঘোষণা করে বলেন:
وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيْهَا وَغَضِبَ اللّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَه عَذَابًا عَظِيْمًا
“আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানেই সে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত হবেন, তার উপর অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রাখবেন।” (সূরা নিসা: ৯৩)
▪ ২) যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন এবং তার নেকিগুলো নিহত ব্যক্তিকে দিবেন আর নেকি যদি কম থাকে তাহলে নিহত ব্যক্তির গুনাহগুলো হত্যাকারীর কাঁধে চাপিয়ে দিবেন। পরিণতিতে সে দুনিয়াতে নামায, রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদি অনেক নেকির কাজ করার পরও নিঃস্ব অবস্থায় জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে:
এ মর্মে হাদিস হল, আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম জিজ্ঞেস করলেন:
أَتَدْرُونَ ما المُفْلِسُ؟ قالوا: المُفْلِسُ فِينا مَن لا دِرْهَمَ له ولا مَتاعَ، فقالَ: إنَّ المُفْلِسَ مِن أُمَّتي يَأْتي يَومَ القِيامَةِ بصَلاةٍ، وصِيامٍ، وزَكاةٍ، ويَأْتي قدْ شَتَمَ هذا، وقَذَفَ هذا، وأَكَلَ مالَ هذا، وسَفَكَ دَمَ هذا، وضَرَبَ هذا، فيُعْطَى هذا مِن حَسَناتِهِ، وهذا مِن حَسَناتِهِ، فإنْ فَنِيَتْ حَسَناتُهُ قَبْلَ أنْ يُقْضَى ما عليه أُخِذَ مِن خَطاياهُمْ فَطُرِحَتْ عليه، ثُمَّ طُرِحَ في النَّارِ
“তোমরা কি জান নি:স্ব কে?”
সাহাবায়ে কেরাম বললেন: “আমাদের মধ্যে নি:স্ব তো সে যার কোন দিনার-দিরহাম বা অর্থ-সম্পদ নেই।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বললেন: “আমার উম্মতের মধ্যে সত্যিকার নি:স্ব হল সেই ব্যক্তি যে, কেয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম ও যাকাতসহ অনেক ভাল কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে অথচ দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো প্রতি অপবাদ দিয়েছিল, করো সম্পদ আত্নসাত করেছিল, কারো রক্তপাত ঘটিয়েছিল, কাউকে মারধোর করেছিল। ফলে তার থেকে নেক আমলগুলো নিয়ে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাওনা আদায় করা হবে।
এভাবে যখন তার নেক আমলগুলো শেষ হয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়ার জন্য আর কিছু থাকবে না তখন তাদের পাপগুলো তাকে দেয়া হবে। ফলে সে (নিঃস্ব অবস্থায়) জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।” (সহিহ মুসলিম)
▪৩) কিয়ামতের দিন বান্দাদের পারস্পারিক অধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে সর্ব প্রথম রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিচার-ফয়সালা করা হবে।
যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেছেন:
أَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي الدِّمَاءِ
‘‘কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যে বিষয়ে মানুষের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করা হবে তা হল রক্তপাত বা খুন-হত্যার বিষয়।’’ (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
এছাড়াও কুরআন-হাদিসে অন্যায় রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতার ব্যাপারে অনেক কঠিন কঠিন বক্তব্য বিবৃত হয়েছে।
🌀 গ. পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ব প্রথম কে হত্যাকাণ্ডের সূচনা করেছিলো এবং তার পরিণতি কী হবে?
মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম খুন করে আদম আলাইহিস সালামের এক ছেলে কাবিল। সে তার আপন ভাই হাবিলকে হত্যা করে। যার কারণে পৃথিবীতে যত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে তার সবগুলোর পাপের একটা অংশ কাবিলের আমলনামায় জমা হবে। কারণ সেই সর্ব প্রথম এ পথ উন্মুক্ত করেছিলো।
এ ব্যাপারে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেছেন:
لاَ تُقْتَلُ نَفْسٌ ظُلْمًا إِلاَّ كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الأَوَّلِ كِفْلٌ مِنْ دَمِهَا وَذَلِكَ لأَنَّهُ أَوَّلُ مَنْ سَنَّ الْقَتْلَ
“অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হলে রক্তে একটা অংশ (হত্যাকাণ্ডে গুনাহে অংশ) প্রথম আদম সন্তান (কাবিল) এর উপর বর্তাবে। কারণ সে প্রথম ব্যক্তি যে হত্যাকাণ্ডের প্রথা চালু করেছে।”
[সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) হাদিস নম্বরঃ [1284] অধ্যায়ঃ ২৩/ জানাযা (كتاب الجنائز)]
পরিশেষে দুআ করি, আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতিকে জুলুম-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করুন, যারা নির্যাতনের শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় গ্রহন করেছেন তাদেরকে দয়া করে শহিদী মর্যাদা দান করুন এবং অন্যায়ভাবে কারো প্রতি অস্ত্র ধারণ তো দূরে থাক একটি কটুকথাও যেন মুখ দিয়ে উচ্চারিত না হয় আমাদেরকে সে তাওফিক দান করুন। আমীন।
▬▬▬◄❖►▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল, সৌদি আরব।।