দ্বীনি ইলম শিক্ষা দান কারী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কতিপয় জরুরি উপদেশ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্য, যিনি বিশ্ব জাহানের একমাত্র প্রতিপালক। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক সর্বশেষ নবী ও সর্বোত্তম রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), তাঁর পরিবারবর্গ এবং সাহাবায়ে কেরামের উপর।
▪️ দ্বীনি ইলম শিক্ষা দান কারী শিক্ষকদের জন্য কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ:
নিঃসন্দেহে শিক্ষকগণ ব্যক্তি গঠনের পাশাপাশি একটি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে। তাই তাদের মর্যাদা যেমন অপরিসীম তেমনি তাদের উপরে দায়-দায়িত্বও অনেক বেশি। নিম্নে এক্ষেত্রে তাদের জন্য কতিপয় জরুরি উপদেশ প্রদান করা হলো:
১. শিক্ষার্থীদের অন্তরে দ্বীনের সঠিক বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য। তাই এমন বিষয়ে তাদের অনুশীলন করানোর চেষ্টা করতে হবে যা ইহকাল ও পরকালে কল্যাণকর। আর এর প্রতিদান আশা করবেন কেবল আল্লাহর কাছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
“মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তিনটি আমল ব্যতীত সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। আমল তিনটি হচ্ছে:
১. সাদাকায়ে জারিয়া,
২. উপকারী বিদ্যা এবং
৩. সৎ সন্তান, যে তার জন্য দুআ করে।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৬৩১]
২. শিক্ষক তার প্রতিটি পদক্ষেপে প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অনুসরণ ও অনুকরণ করবেন। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার নিকট আল্লাহর নবী হবেন, সর্বোত্তম আদর্শ। কেননা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَثَلُ الْعَالِمِ الَّذِي يُعَلِّمُ النَّاسَ الْخَيْرَ وَيَنْسَى نَفْسَهُ، كَمَثَلِ السِّرَاجِ، يُضِيءُ لِلنَّاسِ وَيَحْرِقُ نَفْسَهُ
“যে ব্যক্তি মানুষকে কল্যাণের শিক্ষা দান করে এবং নিজের কথা ভুলে যায় তার উদাহরণ হচ্ছে, প্রদীপের মতো। প্রদীপ নিজেকে জ্বালিয়ে মানুষকে আলো প্রদান করে।” [তাবরানী (আল-মু’জামুল কাবীর), হাদিস নং: ৭২৪৪]
৩. শিক্ষক তার স্কন্ধে অর্পিত আমানতের গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি খাঁটি ইমানের অধিকারী একটি সুন্দর জাতি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করবেন। এ কাজে তিনি আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশা করবেন। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ
“যে ব্যক্তি কল্যাণের দিক নির্দেশনা প্রদান করবে, সে তার বাস্তবায়নকারীর ন্যায় প্রতিদান লাভ করবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৮৯৩]
৪. উস্তাদ পোশাক-পরিচ্ছদ এবং চলাফেরায় উত্তম পন্থা অবলম্বন করবেন এবং ধীরস্থিরতা অবলম্বন করবেন। পাঠ্য বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব ও সম্মানের সহিত লক্ষ্য রাখবেন এবং শ্রেণিকক্ষে প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হবেন।
৫. তিনি পাঠ্য বিষয়ের একটি সীমা নির্ধারণ করবেন। আর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো ছাত্রদের মেধানুযায়ী উত্তম নিয়মে সাজিয়ে নেবেন।
এ ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং উন্নত প্রশিক্ষণ পদ্ধতি থেকে সহযোগিতা নিতে পারেন।
৬. ছাত্রদের নিকট উদ্যমশীলতা ও আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে সওয়াল-জওয়াব (প্রশ্নোত্তর) উপস্থাপন করতে হবে।
৭. উস্তাদ ছাত্রদেরকে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শিক্ষানুযায়ী পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত পাকা-পোক্তভাবে শেখাতে মনোযোগী হবেন।
৭. শিক্ষক হচ্ছেন, মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম। আবু উমামা বাহেলি থেকে বর্ণিত।
ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلَانِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالْآخَرُ عَالِمٌ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرَضِينَ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ
“রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর ঠিক তেমন, যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণ এক ব্যক্তির উপর।’ নিশ্চয় আল্লাহ, ফেরেশতামণ্ডলী এবং আসমান ও জমিনের অধিবাসীরা—এমনকি পিঁপড়া তার গর্তে—এমনকি পানির মাছ—মানুষকে কল্যাণের শিক্ষাদানকারীর জন্য দু’আ করে।” {সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং: ৩৬৪৩; সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং: ২৬৮২; ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২২৩]
৮. তিনি ঐকান্তিকভাবে যত্ন নেবেন—ছাত্রদের শিক্ষাকে তাদের বাস্তব জীবন এবং সমাজের চলমান অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট করতে। আর এক্ষেত্রে তিনি চলমান বিভিন্ন ঘটনা থেকে উদাহরণও উপস্থাপন করবেন। যাতে করে তাদের বোধগম্য হয় যে, ইসলামের বিধি বিধানগুলো বাস্তব, যথার্থ, জীবন্ত, সজীব এবং তা সর্বকাল এবং সর্বস্থানের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।
৯. প্রথমে আল্লাহর উপর অতঃপর নিজের উপর আস্থা স্থাপনের ক্ষেত্রে ছাত্রদের অনুভূতি ও চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে।
১০. অনুরূপভাবে অবসর সময়কে কীভাবে দ্বীন-দুনিয়ার উপকারী কাজে ব্যবহার করা যায় তার সর্বোত্তম সুন্দর এবং সর্বাধুনিক পদ্ধতি শেখাতে হবে। আল্লাহই সকল তাওফিক দাতা।
▪️দ্বীনি ইলম অন্বেষণকারী শিক্ষার্থীদের জন্য কতিপয় উপদেশ:
১. জ্ঞান অর্জনের পথে মজবুতভাবে লেগে থাকো। কারণ এই পথ অত্যন্ত মর্যাদার।
আবু দারদা রা. বলেন, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:
مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللَّهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالْحِيتَانُ فِي جَوْفِ الْمَاءِ وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلَا دِرْهَمًا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ
“যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে রাস্তায় চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তাকে সহজ করে দেবেন। শিক্ষার্থীর (দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা) কর্মের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ফেরেশতারা তাদের ডানাগুলো বিছিয়ে দেয়। আর আলেমের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে—এমনকি পানির মাছও। ইবাদত গুজার একজন ব্যক্তির উপর জ্ঞানী (আলেম) ব্যক্তির মর্যাদা ঠিক সে রকম, যেমন নক্ষত্ররাজিদের উপর একটি চাঁদের মর্যাদা। আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দিনার বা দিরহাম (টাকা-পয়সা ও অর্থ-সম্পদ) উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাননি। তারা উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে গিয়েছেন, শুধু মাত্র ইলম বা ওহির জ্ঞান। যে ব্যক্তি তা অর্জন করবে, সে পরিপূর্ণ লাভবান হবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ২৭২২]
২. জ্ঞান অর্জনের পর তা গোপন না রেখে অন্যদের সাথে ভাগ করে নাও। মানুষের কাছে প্রচার করো।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ اللَّهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لَا يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لَا تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لَا يُسْتَجَابُ لَهَا
“হে আল্লাহ! আপনার কাছে আশ্রয় চাই অপারগতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, অতিবার্ধক্য এবং কবরের আজাব হতে।
হে আল্লাহ! আমার অন্তরে তাকওয়া দান কর। তাকে পবিত্র কর। তুমিই তার সর্বোত্তম পবিত্রতাকারী। তুমিই তার বন্ধু ও কর্তৃত্বকারী।
হে আল্লাহ! তোমার কাছে আশ্রয় কামনা করি এমন জ্ঞান থেকে যা উপকারে আসে না, এমন হৃদয় থেকে যা ভীত হয় না, এমন প্রাণ থেকে যা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দুআ থেকে যা কবুল করা হয় না।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৭২২] মহান আরশের অধিপতি সুমহান আল্লাহর সুউচ্চ দরবারে প্রার্থনা করি, তিনি সবাইকে তাঁর আনুগত্য করা তথা তাঁর আদেশগুলো বাস্তবায়ন এবং নিষেধগুলো থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল কাফী (রহ.)।
সম্পাদনা ও পরিমার্জনা: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
(জুবাইল দাওয়াহ এসোসিয়েশনের সিলেবাস গ্রন্থের ভূমিকা থেকে নেওয়া)।
Share: