প্রশ্ন: দান-সাদকা করার ফজিলত কী? কাকে দান করা যায় এবং দানের পরিমাণ সর্বোচ্চ কত হওয়া কর্তব্য?
উত্তর: নিম্নে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল: و بالله التوفيق
▪ দান-সাদকা করার ফজিলত:
কুরআন-সুন্নায় দান-সাদকা করার ব্যাপারে পর্যাপ্ত ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এ প্রসঙ্গে কয়েকটি আয়াত ও হাদিস তুলে ধরা হলো:
✪ আল্লাহ তাআলা আল্লাহর রাস্তায় দানের প্রতিদান সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন:
ক. মহাগ্রন্থ কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
“যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তার উদাহরণ হচ্ছে সেই বীজের মত যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। আর প্রতিটি শীষে একশতটি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ সুপ্রশস্ত সুবিজ্ঞ।” [সূরা বাকারা: ২৬১]
খ. রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَةً فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَانَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ
“যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কোন কিছু ব্যয় করবে তাকে সাতশত গুণ সওয়াব প্রদান করা হবে।” [আহমদ, তিরমিজি, নাসাঈ-সহিহ]
অর্থাৎ যে কেউ আল্লাহর রাস্তায় অর্থ খরচ করবে, চাই তা জিহাদের প্রয়োজনে খরচ করুক, অথবা গরিব-অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে কিংবা ইসলামের কোনও প্রয়োজনে খরচ করুক কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে বিনিময়ে তার দানকে সাতশো গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে প্রতিদান দিবেন।
✪ আল্লাহর উদ্দেশ্যে দান-সাদকা করা আল্লাহকে ঋণ দেওয়ার মত:
মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَقْرِضُوا اللَّـهَ قَرْضًا حَسَنًا ۚ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنفُسِكُم مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِندَ اللَّـهِ هُوَ خَيْرًا وَأَعْظَمَ أَجْرًا ۚ
“তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্যে যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিত রূপে পাবে।” [সূরা মুযযাম্মিল: ২০]
উক্ত আয়াত সমূহে উল্লেখিত ’আল্লাহকে কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ’ দেওয়ার অর্থ, “আল্লাহর পথে খরচ করা।” [তাফসীর ইবনে কাসির, তাফসিরে বিন সাদি ইত্যাদি]
বিখ্যাত মুফাসসির ইবনে জায়েদ বলেন, “জাকাত দেওয়া ছাড়াও নিজের অর্থ-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করা। এ খরচ আল্লাহর পথে জিহাদ করা, আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য করা, জনকল্যাণমূলক কাজ করা কিংবা অন্যান্য কল্যাণকর কাজেও হতে পারে।”
এভাবে অর্থ ব্যয় করলে আল্লাহ তাকে নিজের জন্য ঋণ বলে গণ্য করেন। তাই তিনি এক্ষেত্রে কেবল আসলটি নয় বরং তার ওপর কয়েকগুণ বেশি দেওয়ার ওয়াদা করেছেন।
✪ দানকারীর জন্য ফেরেশতাদের দুআ আর ব্যয়কুণ্ঠের জন্য বদদুআ:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
– ما من يومٍ يُصبحُ العبادُ فيه إلا وملَكانِ ينزلانِ ، فيقولُ أحدُهما : اللهمَّ أعطِ مُنفقًا خلفًا ، ويقولُ الآخرُ : اللهمَّ أعطِ مُمْسكًا تَلفًا
“প্রতিদিন সকালে দু জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন দানকারীর জন্য দুআ করেন। বলেন, হে আল্লাহ দানকারীকে দানের বিনিময় দান কর। (তার সম্পদ বৃদ্ধি কর) আর দ্বিতীয়জন কৃপণের জন্য বদ দুআ করে বলেন, হে আল্লাহ কৃপণের মালে ধ্বংস দাও।” [বুখারি ও মুসলিম]
✪ ৪. দান-সাদকা করলে সম্পদ কমে না:
আবু কাবশা আল আনমারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছেন যে,
مَا نَقَصَ مَالُ عَبْدٍ مِنْ صَدَقَةٍ
“সদকা করলে কোন মানুষের সম্পদ কমে না।” [সহিহ মুসলিম, হা/২৫৮৮]
✪ ৫. দান-সাদকা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার মাধ্যম:
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মর্মে বলেছেন,
«اتَّقُوْا النَّارَ وَ لَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ»
‘‘তোমরা খেজুরের অর্ধেক দান করে হলেও আগুন থেকে বাঁচ।’’[বুখারী, অধ্যায়: জাকাত, অনুচ্ছেদ: খেজুরের একাংশ দান করে হলেও আগুন থেকে বাঁচ]
✪ ৬. সাদকায়ে জারিয়ার সওয়াব মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ »
“মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায় তবে তিনটি ছাড়া।(সেগুলো হলো)
– সাদকায়ে জারিয়া (এমন দান যা দ্বারা মানুষ দীর্ঘদিন উপকৃত হয়),
– এমন ইলম (শরিয়ত বিষয়ক জ্ঞান) যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়
– এবং এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দুআ করে।” [সহিহ মুসলিম, হা/৪৩১০]
কুরআন-হাদিসের দান-সাদকার আরও অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
▪ কাদেরকে দান করব?
সাধারণভাবে গরিব-অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষকে, জন কল্যাণকর কাজে এবং দ্বীনের প্রয়োজনে সাহায্য করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। তবে নিজ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে গরিব, এতিম ও অসহায় মানুষের উদ্দেশ্যে দান করা অধিক উত্তম। এদেরকে দান করলে দু ধরণের সওয়াবের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِيْنِ صَدَقَةٌ وَهِىَ عَلَى ذِى الْقَرَابَةِ اثْنَتَانِ صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ
“দরিদ্রকে দান করলে কেবল সদকার সওয়াব পাওয়া যায়। আর আত্মীয়কে দান করলে সদকার সওয়াব এবং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার সওয়াব উভয়ই পাওয়া যায়।” [তিরমিজি, হা/৬৫৮ ও ইবনে মাজাহ, হা/১৮৪৪, সনদ সহীহ]
এ মর্মে আরও একাধিক হাদিস রয়েছে।
▪ কী পরিমাণ দান করা যায়?
আল্লাহ তাআলা যাকে অর্থ-সম্পদ দান করেছেন সে যত বেশি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে গরিব-অসহায় মানুষ, জনকল্যাণকর কাজ অথবা দ্বীনের সেবায় অর্থ দান করবেন আল্লাহ তাআলা তাকে তত বেশি সওয়াব দান করবেন। কেউ সুস্থ-সবল ও স্বাভাবিক অবস্থায় চাইলে তার জীবন পরিচালনা এবং তার স্ত্রী-পরিবারের অত্যাবশ্যকীয় খরচ ছাড়া তার সমূদয় সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে দেওয়ার অধিকার রাখে। এতটা দান উচিত নয় যে, সব কিছু দান করার পর সে নিঃস্ব হয়ে যায়। তবে যদি সে শারীরিকভাবে অর্থ-উপার্জনে সক্ষম হয় তাহলে ভিন্ন কথা।
সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হয় যে, প্রশ্ন: এক তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করা উত্তম নাকি সম্পূর্ণ সম্পদ?
তিনি বলেন,
لا بدّ أن يُبقي له ما ينفعه ولا يتصدّق به كله، مثلما قال ﷺ لكعبٍ: أمسك عليك بعض مالك فهو خيرٌ لك، فيتصدّق بما تيسَّر، ويُبقي ما يُعينه على طاعة الله، ويُنفق على أهله.
“যা তার উপকারে আসবে তা তাকে অবশ্যই রাখবে; সব সম্পদ দান করবে না, যেমনটি তিনি কাব রা. কে বলেছিলেন,
أَمْسِكْ عَلَيْكَ بَعْضَ مَالِكَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ
“তুমি তোমার মালের কিছু অংশ রেখে দাও; তা তোমার জন্য উত্তম হবে।”
[সুনানে নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৩৫/ মানত ও কসম, পরিচ্ছেদ: ৩৬. মানত হিসেবে হাদিয়া দেওয়া]
অতএব যথাটা সম্ভব দান করবে এবং এতটুকু রেখে দিবে যা দ্বারা সে আল্লাহর আনুগত্য করতে পারবে এবং তার পরিবারের জন্য ব্যয় করতে পারবে।”
তবে মৃত্যুর পূর্বক্ষণে মুমূর্ষু অবস্থায় দান (ওসিয়ত) করতে চাইলে ইসলাম একটি পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আর তা হল, সর্বোচ্চ এক তৃতীয়াংশ। এর চেয়ে বেশি দান করা জায়েজ নাই। বরং এর চেয়ে কম হলেই ভালো। মুমূর্ষু অবস্থায় দানের ক্ষেত্রে কেউ যদি তার ধন-সম্পদ সব কিছু দানের ওসিয়ত করে যায় তাহলে তার মধ্যে কেবল এক তৃতীয়াংশ কার্যকর হবে। বাকিটা তার ওয়ারিশদের মাঝে যথানিয়মে বণ্টিত হবে।
🔸 সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বিদায় হজের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। পথিমধ্যে আমি প্রচণ্ড রোগে আক্রান্ত হলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার সেবা-শুশ্রূষা করতে এলে আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর রসূল, আমার অনেক সম্পত্তি। কিন্তু আমার ওয়ারিশ হওয়ার মত কেউ নাই একমাত্র মেয়ে ছাড়া। আমি আমার সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ ওসিয়ত করব?
তিনি বললেন, না।
আমি বললাম, অর্ধেক?
তিনি বললেন, না।
আমি বললাম, তবে তিন ভাগের একভাগ?
তিনি বললেন, “তিন ভাগের একভাগ! তিন ভাগের একভাগই তো বেশি। সাদ, তোমার উত্তরাধিকারীদেরকে দরিদ্র অবস্থায় রেখে যাবে আর তারা মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে বেড়াবে এর চেয়ে তাদেরকে সম্পদশালী করে রেখে যাওয়াই উত্তম।” [বুখারী ও মুসলিম]
– এক তৃতীয়াংশের চেয়ে কম করা উত্তম। ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
لَوْ غَضَّ النَّاسُ إِلَى الرُّبْعِ ، لأَنَّ رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – قَالَ « الثُّلُثُ ، وَالثُّلُثُ كَثِيرٌ أَوْ كَبِيرٌ »
“মানুষ যদি (সম্পত্তি ওসিয়ত করার ক্ষেত্রে) এক তৃতীয়াংশ থেকে এক চতুর্থাংশে নেমে আসত তবে উত্তম হত। কেননা, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তিন ভাগের একভাগ! তিন ভাগের একভাগই তো বেশি।” [বুখারি ও মুসলিম] আল্লাহু আলাম।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬ উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল। (লিসান্স, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়)।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।