নিম্নে মেহরাব শব্দের সঠিক অর্থ এবং এ সংক্রান্ত প্রচলিত ভুল ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
বিশিষ্ট আরবি ভাষাবিদ ইবনুল আসির (মৃত্যু: ৬০৬ হিজরি) তার নেহায়া (النهاية في غريب الحديث والأثر) গ্রন্থে বলেন, “মেহরাব (المحراب) শব্দের অর্থ: সুউচ্চ ও সম্মানজনক স্থান, যা সভা বা মজলিসের অগ্রভাগে থাকে।
এখান থেকেই মসজিদের মেহরাব শব্দটিকে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তা মসজিদের সম্মুখভাগে থাকে এবং সবচেয়ে সম্মানজনক স্থান।”
قال ابن الأثير في “النهاية” :
المحْرابُ : المَوْضع العَالي المُشْرِفُ ، وهُو صَدْر المَجْلس أيضاً ، ومنه سُمّي محْراب المسْجد ، وهو صَدْرُه وأشْرَف مَوْضِع فيه . انتهى
ইবনে মানযুর তার বিখ্যাত অভিধান লিসানুল আরব গ্রন্থে বলেন,
المحراب : صدر البيت ، وأكرم موضع فيه، والجمع المحاريب هو أيضا الغرفة
“মিহরাব অর্থ: বাড়ির প্রধান অংশ এবং সবচেয়ে সম্মানজনক স্থান। বহুবচন মাহারিব। এর আরেকটি অর্থ ঘর বা কক্ষ।”
▪️ মেহরাব এর ভিত্তিহীন ব্যাখ্যা এবং তার অপনোদন:
আমাদের সমাজের অনেক ইসলামি বক্তা, ওয়াজ কারি বা তথাকথিত ধর্মীয় রাজনীতি নেতার বক্তব্যে প্রায়ই মেহরাব শব্দের ভুলভাল ব্যাখ্যা শুনতে পাওয়া যায়। যেমন তারা বলে থাকে, মেহরাব শব্দটি হারব (যুদ্ধ) থেকে এসেছে। যার অর্থ, অস্ত্র রাখার স্থান বা অস্ত্রাগার। এই ব্যাখ্যা দেওয়ার পরে তারা বলে যে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম-এর যুগে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিগণ নামাজের সময় মসজিদের মেহরাবে তাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা রেখে সালাতে দণ্ডয়মান হতেন। যেন কাফেররা আক্রমণ করলে সালাত ছেড়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারেন। এই কারণে নামাজের সামনে অস্ত্র রাখার স্থানকে মেহরাব বলা হয়!”
কিন্তু এটা চরম ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ব্যাখ্যা। কোন হাদিসেই এরকম বক্তব্য আসেনি। এমনকি মেহরাব শব্দের এমন ব্যাখ্যা কোন আরবি ভাষাবিদ বলেনি বা আরবি অভিধানে বলা হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য আমাদের সমাজের অনেক নামধারী আলেম বা বক্তা মূর্খ শ্রোতাদের সামনে এইসব আবোল-তাবোল ও ভিত্তিহীন ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেকে ‘জ্ঞানী’ প্রমাণ করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু তা নিছক মূর্খতা বৈ কিছু নয়। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে শুধু নয় ইসলামের প্রথম শতাব্দীতেও মসজিদের কোন মেহরাব ছিল না। দ্বিতীয় শতকে সর্বপ্রথম মেহরাব এর প্রচলন হয়। এর উদ্দেশ্য হল, কিবলা নির্দেশনা। অর্থাৎ মসজিদের ভিতরে মেহরাবের দিকটাই কিবলা। (Islamqa)।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের বিস্তৃতির ফলে ব্যাপক আকারে মসজিদ নির্মিত হয়। তাই মানুষ সহজেই যেন মসজিদে প্রবেশ করে কিবলা দিকটি চিনতে পারে এই জন্য মেহরাব বানানোর প্রচলন শুরু হয়। যার কারনে কাবা ঘরে কখনোই মেহরাব ছিল না, এখনো নেই। কারণ এখানে আলাদাভাবে কেবলা চিহ্নিত করার প্রয়োজন নেই। অবশ্য কিছু আলেমের মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকেই মক্কার মসজিদুল হারাম ব্যতিরেকে অন্যান্য মসজিদগুলোতে মেহরাব এর প্রচলন ছিল। আল্লাহু আলম।
🔸মেহরাব শব্দের আরেক অর্থ: কক্ষ বা ঘর। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَخَرَجَ عَلَىٰ قَوۡمِهِۦ مِنَ ٱلۡمِحۡرَابِ فَأَوۡحَىٰٓ إِلَيۡهِمۡ أَن سَبِّحُواْ بُكۡرَةٗ وَعَشِيّٗا
“তারপর তিনি (মরিয়ম আ. ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট) কক্ষ হতে বের হয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে আসলেন এবং ইঙ্গিতে তাদেরকে সকাল-সন্ধায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে বললেন।’ [সূরা মরিয়ম: ১১]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
كُلَّمَا دَخَلَ عَلَیۡهَا زَكَرِیَّا ٱلۡمِحۡرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزۡقا
“যখনই জাকারিয়া তার (মরিয়ম আলাইহাস সালাম) কক্ষে প্রবেশ করতেন তখনই তার নিকট খাদ্য-সামগ্রী দেখতে পেতেন।” [সূরা আল ইমরান: ৩৭]
এই আয়াতে মেহরাব শব্দের অর্থ, একটি উঁচু ঘর যেখানে মারিয়াম আলাইহিস সালাম অবস্থান করতেন। সেখানে জাকারিয়া আ. সিঁড়ির মাধ্যমে উঠতেন। যেমনটি তাফসীরে কুরতুবিতে বলা হয়েছে।
إنها كانت في غرفة كان زكريا يصعد إليها بسلم
[তাফসীরে কুরতুবী]
আল্লাহ আমাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করার তৌফিক দান করুন এবং সব ধরনের অপব্যাখ্যা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।