জীবনে যদি সুখ-সমৃদ্ধি ও ভালো কিছু ঘটে তখন কী করণীয় এবং এ ক্ষেত্রে কীভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয়

জীবনে যদি সুখ-সমৃদ্ধি এবং ভালো কিছু ঘটে তখন কী করণীয়? এ ক্ষেত্রে কীভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয়? সমাজ জীবনে এবং একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের কেমন থাকার চেষ্টা করা উচিৎ?

প্রশ্ন: যখন জীবনে শুধু ভালো বিষয়ই ঘটতে থাকে তথা সুখের জীবন হয় তখন কীভাবে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা উচিত যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন? জীবনে আল্লাহ ও তার রসুলের আদেশ নিষেধ মেনে চলার পাশাপাশি যদি বৈধ উপায়ে হাসিখুশি জীবন যাপন করা হয় বা হাসি মুখে থাকা যায় এটা কি অকল্যাণের বা জাহান্নামে যাওয়ার কোনও কারণ? যদিও মৃত্যুকে স্মরণ করা হয় এবং নেক আমল করা হয় এবং হারাম থেকে দূরে থাকা হয়?
অনবরত যদি ভালো বিষয়ই ঘটে জীবনে এক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা আদায় করার পর আর কি করণীয় রয়েছে? সুখের কারণে যদি শুকরিয়া আদায় করা হয় এটা কি যে কারও জন্য কল্যাণের? হাসি খুশি জীবন যাপন করা নিয়ে ইসলাম কী বলে? এ বিষয়ে দয়া করে সম্ভব হলে কুরআন ও হাদিসের বক্তব্য কি জানাবেন ইনশাআল্লাহ।

উত্তর: পার্থিব জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি, মান-সম্মান, পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ-সম্পদ, সুখময় দাম্পত্য জীবন, সুসন্তান, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, সুন্দর আচরণ, সুমিষ্ট কথা, উত্তম চরিত্র, সুস্বাস্থ্য, শারীরিক সৌন্দর্য, নিখুঁত দৈহিক গঠন ইত্যাদি সব কিছু মহান আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত এবং দুনিয়াবি কল্যাণ।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়ে দুআ শিক্ষা দান করেছেন। তা হলো,

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

“হে আমাদের পালনকর্তা, আপনি আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দান করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে হতে রক্ষা করুন।” [সূরা বাকারা: ২০১]

সুতরাং একজন মানুষ যখন এসব দুনিয়াবি নিয়ামত লাভ করবে তখন তার কর্তব্য হবে, মহান দয়ালু ও দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ময় জীবন, সুস্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, অর্থ-সম্পদ ও অন্যান্য নিয়ামতরাজি দ্বারা সম্মানিত করেছেন সেগুলো হালাল পন্থায় উপভোগ করা। আর তাঁর দরবারে অবনত মস্তকে কৃতজ্ঞতা আদায় করা। তাহলে তিনি খুশি হবেন এবং তাকে আরও বেশি নিয়ামত দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন।আল্লাহ তাআলা বলেন,

‏ وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ

“এবং তোমার পালনকর্তার নিয়ামতের কথা প্রকাশ করো।” [সূরা যোহা: ১১]

তিনি আরও বলেন,

لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ

“তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও তবে আমি তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।” [সূরা ইবরাহিম: ৭]

তাই মহান আল্লাহ আমাদেরকে যে সব নিয়ামত দিয়েছেন সেগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করা জরুরি। তাহলে তিনি আমাদেরকে আরও দিবেন। অন্যথায় তাঁর কঠোর শাস্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।

আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের পদ্ধতি:

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার পদ্ধতি হল, মুখে তাঁর নিয়ামতের স্বীকৃতি দেওয়া, বিনয় সহকারে জীবনে সেগুলোর প্রকাশ ঘটানো, অহংকার মুক্ত জীবন যাপন করা এবং মৌখিকভাবে তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করা (আল হামদুলিল্লাহ “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য” পাঠ করা)। পাশাপাশি কর্মের মাধ্যমেও তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে তাঁর ইবাদত-বন্দেগি ও বিধি-বিধানগুলো যত্ন সহকারে মেনে চলার মাধ্যমে। অনুরূপভাবে তাঁর দেওয়া নিয়ামতরাজিকে হারাম কাজে ব্যবহার না করাও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।
জীবনে কখনো বিপদ বা সংকটের সম্মুখীন হলে চরম ধৈর্যের পরিচয় দিবে, তাঁর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করা যাবে না এবং হাহুতাশ করা যাবে না বরং আল্লাহর সিদ্ধান্তকে সে প্রশস্ত হৃদয়ে ও সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করে নিবে। এটি একজন কৃতজ্ঞ মুমিন বান্দার পরিচয় এবং এটি তাকদিরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ।

◆ আবু ইয়াহিয়া সুহাইব ইবনে সিনান রা. থেকে বর্ণিত আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

عَجَباً لأََمْرِ المُؤمنِ إنَّ أمْرَهُ كُلَّهُ لَهُ خيرٌ ولَيسَ ذلِكَ لأَحَدٍ إلاَّ للمُؤْمِن : إنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكانَ خَيراً لَهُ، وإنْ أصَابَتْهُ ضرَاءُ صَبَرَ فَكانَ خَيْراً لَهُ

“মুমিনের ব্যাপারটাই আশ্চর্যজনক। তার প্রতিটি কাজে তার জন্য মঙ্গল রয়েছে। এটা মুমিন ব্যতীত অন্য কারো জন্য নয়। সুতরাং তার আনন্দ দায়ক কিছু ঘটলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। ফলে এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর কষ্টদায়ক কোন কিছু ঘটলে সে ধৈর্য ধারণ করে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়।’’ [মুসলিম ২৯৯৯, আহমদ ১৮৪৫৫, ১৮৪৬০, ২৩৪০৬, ২৩৪১২, দারেমি ২৭৭৭]

◆ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,

الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ ، وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ ، وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلَا تَعْجَزْ ، وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ فَلَا تَقُلْ : لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا ، وَلَكِنْ قُلْ : قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ ، فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ “

“শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে অধিক উত্তম এবং আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। আর সবকিছুতেই কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং যাতে তোমার কল্যাণ রয়েছে তা অর্জনে আগ্রহী হও এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা কর। দুর্বলতা প্রদর্শন করো না। তবে যদি তোমার কোন কাজে কিছু ক্ষতি সাধিত হয়, তখন তুমি এভাবে বলো না যে, “যদি আমি কাজটি এভাবে করতাম তা হলে আমার এই এই হত।” বরং বল, “আল্লাহ এটাই তকদিরে রেখেছিলেন। আর তিনি যা চান তা-ই করেন।” কেননা ‘যদি’ শব্দটি শয়তানের কাজের পথকে উন্মুক্ত করে দেয়।” [মুসলিম, মিশকাত হা/৫২৯৮]

সমাজ জীবনে এবং একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের কেমন থাকার চেষ্টা করা উচিৎ?

• সমাজ জীবনে মানুষের সাথে উঠাবসা, লেনদেন ও চলাফেরার ক্ষেত্রে হাসিখুশি থাকা খুব চমৎকার মানবিক গুণ। মানুষের সাথে হাসিখুশি থাকা একজন মানুষের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, উন্নত মন-মানসিকতা, বিনয় ও উত্তম চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এতে সে মানুষের নিকট প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠে এবং সমাজ জীবনে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়। এটি নিঃসন্দেহে দুনিয়ার জীবনে বিরাট প্রাপ্তি।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রী-পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও সঙ্গী-সাথীদের সাথে সাক্ষাতের সময় হাসিখুশি অবস্থায় সাক্ষাৎ করতেন, হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় কথা বলতেন, আনন্দ দায়ক উপাধি দ্বারা সম্বোধন করতেন এবং কখনো কখনো তাদের সাথে কৌতুক বা মজা করতেন (হালাল পন্থায়)। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। মহান আল্লাহ বলেন,

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

“নিশ্চয় তোমাদের জন্য জন্যে রসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” [সূরা আহযাব: ২] সুতরাং আমাদের কর্তব্য, তাঁকে অনুসরণ করা।

কিন্তু ব্যক্তিগত একান্ত নির্জনে ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় একজন আল্লাহ ভীরু মুমিনের কর্তব্য, সে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করবে, মৃত্যু পরবর্তী জীবন ও আখিরাতের হিসাব-নিকাশ, হাশরের মাঠের সংকটময় পরিস্থিতি, আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো, পুলসিরাতের ভয়াবহ পথ এবং জাহান্নামের শাস্তির কথা চিন্তা করে ভীত-ত্রস্ত ও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকবে এবং পরকালীন মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর নিকট আরাধনা ও কান্নাকাটি করবে।
এভাবে জীবন-যাপন করাই একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য হওয়া কর্তব্য। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার। সৌদি আরব।

Share: