হিজরি ক্যালেন্ডারের ১১ তম মাস হল, জিলকদ মাস। এর পরের মাসই জিলহজ মাস-যাতে ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানে মুসলিম বিশ্বের সর্ব বৃহৎ গণ জমায়েত এবং ইসলামের ৫ম স্তম্ভ হজ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু হজের প্রস্তুতি শুরু হয় আরও বহু আগে থেকে।
যাহোক, এ মাসটি ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদায় সমুজ্জ্বল। নিম্নে এ বিষয়ে অতি সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল:
وبالله التوفيق وهو المستعان
❑ জিলকদ মাসের তিনটি অনন্য বৈশিষ্ট্য:
◈ ১. এ মাসের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল, এটি হজের তিনটি মাসের মধ্যে অন্যতম। আশহুরুল হজ বা হজের মাস হল, তিনটি। যথা:
ক. শাওয়াল,
খ. জিলকদ
গ. ও জিলহজ।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ
“হজ অনুষ্ঠিত হয়, সুপরিচিত কয়েকটি মাসে।” [সূরা বাকারা: ১৯৭]
ইবনে উমর রা. বলেন,
” أَشْهُرُ الحَجِّ: شَوَّالٌ، وَذُو القَعْدَةِ، وَعَشْرٌ مِنْ ذِي الحَجَّةِ”
“হজের মাস হল, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের দশ দিন।”
ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
” مِنَ السُّنَّةِ: أَنْ لاَ يُحْرِمَ بِالحَجِّ إِلَّا فِي أَشْهُرِ الحَجِّ”
” সুন্নত হল, হজের মাস ছাড়া অন্য মাসে হজের ইহরাম না বাধা।” [সহিহ বুখারি]
◈ ২. এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এটি চারটি হারাম (সম্মানিত ও নিষিদ্ধ মাস) মাসের মধ্যে একটি।
হারাম চারটি মাস হল:
ক. জিলকদ
খ. জিলহজ
গ. মুহাররম
ঘ. রজব
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ ۚ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنفُسَكُمْ
“নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি হল, হারাম (সম্মানিত ও নিষিদ্ধ)। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম (পাপাচার) করো না।” [সূরা তওবা: ৩৬]
প্রখ্যাত সাহাবি আবু বাকরা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,
إن الزَّمَان قَدْ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللَّهُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا، مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلاَثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ: ذُو القَعْدَةِ وَذُو الحِجَّةِ وَالمُحَرَّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ، الَّذِي بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ” (رواه البخاري ومسلم).
“আল্লাহ তাআলা আসমান সমূহ এবং জমিন সৃষ্টির দিন যে আকৃতিতে সময়কে সৃষ্টি করেছিলেন সেটা আবার তার নিজস্ব আকৃতিতে ফিরে এসেছে। বারো মাসে এক বছর। তম্মধ্যে চারটি মাস হল, হারাম (অতি সম্মানিত ও নিষিদ্ধ)। তিনটি মাস ধারাবাহিক। সেগুলো হল: জিলকদ, জিলহজ এবং মুহররম এবং আরেকটি হল মুযার সম্প্রদায়ের রজব মাস যা জুমাদাল ঊলা এবং শাবানের মধ্যখানে রয়েছে।” [বুখারি ও মুসলিম]
❑ এ মাসগুলো হারাম হওয়ার কারণ:
ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
اختص الله أربعة أشهر جعلهن حرمًا، وعظَّم حرماتهن، وجعل الذنب فيهن أعظم، وجعل العمل الصالح والأجر أعظم
“আল্লাহ তাআলা বারো মাসের মধ্যে বিশেষভাবে চার মাসকে হারাম হিসেবে নির্ধারণ করেছেন এবং সেগুলোর বিশাল মর্যাদা দিয়েছেন, এগুলোতে পাপাচার করাকে আরও বেশি ভয়ানক করেছেন এবং নেক আমলের বিশাল প্রতিদানও নির্ধারণ করেছেন।” [তাফসিরে ইবনে কাসির]
◈ ৩. এ মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের পরে মোট চারটি ওমরা আদায় করেছেন। সেগুলোর মধ্যে হজের সাথে যে ওমরা করেছেন সেটি ছাড়া বাকি সবগুলোই আদায় করেছেন জিলকদ মাসে।
কাতাদা রা. হতে বর্ণিত, আনাস রা. তাকে এ তথ্য দিয়েছেন যে,
اعْتَمَرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَرْبَعَ عُمَرٍ كُلُّهُنَّ فِي ذِي الْقَعْدَةِ، إِلاَّ الَّتِي كَانَتْ مَعَ حَجَّتِهِ. عُمْرَةً مِنَ الْحُدَيْبِيَةِ فِي ذِي الْقَعْدَةِ، وَعُمْرَةً مِنَ الْعَامِ الْمُقْبِلِ فِي ذِي الْقَعْدَةِ، وَعُمْرَةً مِنَ الْجِعْرَانَةِ حَيْثُ قَسَمَ غَنَائِمَ حُنَيْنٍ فِي ذِي الْقَعْدَةِ، وَعُمْرَةً مَعَ حَجَّتِهِ.
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি ওমরা পালন করেছেন। তিনি হজের সাথে যে ওমরাটি পালন করেছিলেন সেটি ব্যতীত সবকটিই জিলকদ মাসে পালন করেছেন।
– হুদায়বিয়া নামক স্থানে যে ওমরাটি পালন করেছিলেন সেটি ছিল জিলকদ মাসে,
– তার পরের মাসে যে ওমরা পালন করেছেন সেটাও জিলকদ মাসে
– এবং হুনাইনের গনিমত (যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ) যে জিরানা নামক স্থানে বণ্টন করেছিলেন, সেখান থেকে যে ওমরাটি করা হয়েছিল তাও ছিল জিলকদ মাসে।
– আর তিনি হজের সাথে একটি ওমরা পালন করেন।”
[সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫১/ মাগাযী (যুদ্ধ-অভিযান), পরিচ্ছেদ: ২১৯৯. হুদায়বিয়ার যুদ্ধ। মহান আল্লাহর বাণী: لَّقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ “মুমিনগণ যখন গাছের নিচে আপনার নিকট বয়াত গ্রহণ করল তখন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন…।” [সূরা আল ফাতহ: ১৮]
◍ জিলকদ মাসে ওমরা করার কারণ কী?
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজের সাথে যে ওমরা আদায় করেছেন সেটা ছাড়া বাকি ৩টি ওমরা আদায় করেছেন জিলকদ মাসে। এর কারণ হিসেবে আলেমগণ বলেছেন, ইসলাম পূর্ব জাহেলি যুগে এ মাসে ওমরা করাকে খুবই গুনাহের কাজ মনে করা হত। তাই তিনি এ মাসে একাধিক ওমরা করার মাধ্যমে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছেন যে, জাহেলি যুগের ধারণা ভ্রান্ত-বাতিল এবং এ মাসে ওমরা করা জায়েজ।
وقال النووي :
قال العلماء : وإنما اعتمر النبي صلى الله عليه وسلم هذه العُمَر في ذي القعدة لفضيلة هذا الشهر ولمخالفة الجاهلية في ذلك فإنهم كانوا يرونه ( أي الإعتمار في ذي القعدة ) من أفجر الفجور كما سبق ففعله صلى الله عليه وسلم مرات في هذه الأشهر ليكون أبلغ في بيان جوازه فيها وأبلغ في إبطال ما كانت الجاهلية عليه ، والله أعلم .
” شرح مسلم ” ( 8 / 235 ) .
◍ জিলকদ মাসে ওমরা করা কি সুন্নত?
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক এ মাসে একাধিক ওমরা করার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। সে কারণে অনেক আলেম জিলকদ মাসে ওমরা করাকে সুন্নত বলেছেন। যদিও তা যে কোনও সময় করা জায়েজ।
– শাইখ বিন বায রাহ. বলেন, সবচেয়ে মর্যাদা পূর্ণ রোজা হল, রমজান মাসে রোজা করা। কেননা তা হজের সমান। এর পরেই জিলকদ মাসে ওমরা করা উত্তম।
فضل زمان تؤدي فيه العمرة شهر رمضان؛ لقول النبي صلى الله عليه وسلم “عمرة في رمضان تعدل حجة”. متفق على صحته، وفي رواية أخرى في البخاري “تقضي حجة معي”، وفي مسلم “تقضي حجة أو حجة معي” ــ هكذا بالشك ــ يعني معه عليه الصلاة والسلام، ثم بعد ذلك العمرة في ذي القعدة؛ لأن عمره كلها، صلى الله عليه وسلم، وقعت في ذي القعدة، وقد قال الله سبحانه (لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة). وبالله التوفيق
– আল্লামা উসাইমিন, হজের মাসগুলোতে ওমরা করাকে সুন্নত বলেছেন।
وتسن أيضاً في أشهر الحج، وهي شوال وذو القعدة وذو الحجة؛ لأن النبي صلّى الله عليه وسلّم خصها بالعمرة.
আল্লাহু আলাম।
– আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল –