প্রশ্ন: আল্লাহ তাআলা মানুষ এবং জিন করেছেন। আমি জানতে চাই, জিনদের মধ্যে কি নারী-পুরুষ আছে? যদি থাকে তাহলে এরা কি বংশ বিস্তার করে? আর এরা কোথায় থাকে? এদের কি কোন দেশ আছে?
উত্তর:
নিম্নে কুরআন, হাদিস ও আলেমদের মতামতের আলোকে জিন সংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হল:
وبالله التوفيق و السداد
■ জিনদের মাঝে নারী-পুরুষ:
মানুষের মতই জিনদের মাঝেও পুরুষ এবং নারী জিন আছে। যেমন: আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টয়লেটে প্রবেশ কালে বলতেন,
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْخُبْثِ وَالْخَبَائِثِ
“আল্লাহুম্মা ইন্নী আঊযুবিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাবাইস”
“হে আল্লাহ, তোমার নিকট নাপাক নর-নারী জিন-শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।” (বুখারি ও মুসলিম)
■ জিনদের সন্তান-সন্তুতি ও বংশ বিস্তার:
জিনরাও জন্ম গ্রহণ করে, তাদের বংশ বিস্তার হয় এবং তাদের সন্তান-সন্ততি আছে। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ
“অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে (ইবলিস) এবং তার বংশধরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করছ?” (সূরা কাহাফ: ৫০)
বিশিষ্ট মুফাসসির আলুসি বলেন, “এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থে থেকে বুঝা যায়, জিনদের সন্তান-সন্ততি আছে।”
অবশ্য কোনও কোন মুফাসসির বলেন, এখানে ‘শয়তানের বংশধর’ বলতে শয়তানের অনুসারী উদ্দেশ্য।
عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما قال: (إن الله جزَّأ الإنس والجن عشرة أجزاء، فتسعة منهم الجن، والإنس جزء واحد، فلا يولد من الإنس ولد إلا ولد من الجن تسعة
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, আল্লাহ তাআলা মানুষ আর জিনকে দশভাগে ভাগ করেছেন। তম্মধ্যে নয়ভাগ জিন আর একভাগ মানুষ। সুতরাং একজন মানব সন্তান জন্ম নিলে জিনদের সন্তান জন্ম নেয় নয় জন।” (তাফসিরে ইবনে আবী হাতেম, পৃষ্ঠা: ২৩৮৭)
কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত,
أنه ينكح وينسل كما ينكح وينسل بنو آدم
“জিন বিয়ে ও বংশ বিস্তার করে যেভাবে আদম সন্তানরা বিয়ে ও বংশ বিস্তার করে।”
[তাফসিরে রূহুল মাআনি ১৫/২৯৫] অনুরূপ কথা বলেছেন, হাসান বসরি। (তাফসিরে ত্ববারি ১/২২৬)
■ জিনরাও মৃত্যু বরণ করে:
জিনরা মৃত্যুবরণ করে। ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআর মধ্যে বলতেন,
أَنْتَ الْحَىُّ الَّذِي لاَ يَمُوتُ وَالْجِنُّ وَالإِنْسُ يَمُوتُونَ
“(হে আল্লাহ,) আপনি চিরঞ্জীব, যিনি কখনো মৃত্যুবরণ করেন না। অথচ মানুষ ও জিন মৃত্যুবরণ করে।’ (বুখারি/৭৩৮৩)
ইবলিশও জিনজাতির অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু অন্য জিনরা তার মতো নয়। ইবলিশকে কিয়ামত পর্যন্ত জীবন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ সুযোগ অন্য কোনো জিনকে দেওয়া হয়নি। ইবলিশের জীনব কাল সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
قَالَ أَنظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ – قَالَ إِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ
”সে বললঃ আমাকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। (14) আল্লাহ বললেনঃ তোকে সময় দেয়া হল। (সূরা আরাফ: ১৪ ও ১৫)
■ জিনদের বসবাস:
● ড. উমর আল আশকার তার বিখ্যাত “জিন ও শয়তান জগত” (আরবি) গ্রন্থে বলেন,
“ধ্বংসস্তূপ, জনমানবশূন্য এলাকা এবং নোংরা স্থানে তারা বেশি থাকে। যেমন: গোসলখানা, পেশাব-পায়খানার ঘর, ময়লা ফেলার স্থান, গোরস্থান ইত্যাদি।”
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِنَّ هذِهِ الْحُشُوْشَ مُحْتَضَرَةٌ فَإِذَا أَتى أَحَدُكُمُ الْخَلَاءَ فَلْيَقُلْ أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ. رَوَاهُ أَبُوْ دَاوٗدَ وَاِبْنُ مَاجَةَ
যায়েদ ইবনে আরকাম রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “এ সব টয়লেটে জিন-শয়তানরা উপস্থিত হয়। সুতরাং তোমাদের যারা টয়লেটে যাবে তারা যেন এ দু’আ পড়ে:
أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ
উচ্চারণ: “আ’উযু বিল্লাহি মিনাল খুবুসি ওয়াল খবায়িস।”
“আমি আল্লাহর নিকট নাপাক নর ও নারী জিন-শয়তান থেকে আশ্রয় চাই।”
[সহীহ-আবু দাউদ/৬, ইবনে মাজাহ্/২৯৬, সহীহুল জামি/ ২২৬৩।]
● বাজার-মার্কেটে ইবলিশ এবং তার বংশধর উপস্থিতি বেশি থাকে। এরা সেখানে মানুষকে নানাভাবে ফেতনায় ফেলে ও অন্যায়-অপকর্মে প্ররোচিত করে। তাই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজারে অবস্থান করতে নিষেধ করেছেন। তিনি সালমান রা. কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,
لَا تَكُونَنَّ إِنْ اسْتَطَعْتَ أَوَّلَ مَنْ يَدْخُلُ السُّوقَ ، وَلَا آخِرَ مَنْ يَخْرُجُ مِنْهَا ، فَإِنَّهَا مَعْرَكَةُ الشَّيْطَانِ ، وَبِهَا يَنْصِبُ رَايَتَهُ
“যদি পারো তাহলে বাজারে সর্বপ্রথম প্রবেশ কারী হয়ো না এবং এমনটাও হয়ো না যে, তুমি হবে সেখান থেকে সর্বশেষ প্রস্থান কারী। কারণ তা শয়তানের যুদ্ধক্ষেত্র। সে সেখানে তার ঝাণ্ডা স্থাপন করে। (সহিহ মুসলিম, হা/ ২৪৫১)
কারণ বাজারগুলোতে বিভিন্ন প্রকার অন্যায় কার্যক্রম সংঘটিত হয়। যেমন: ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মিথ্যা কথা, কসম, বাতিল চুক্তি, নিষিদ্ধ জিনিসের দিকে হারাম দৃষ্টিপাত, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। এসব হয় ইবলিস ও তার সহযোগীদের প্ররোচনায়।
● এ ছাড়াও হাদিস থকে জানা যায় যে, ইবলিশ সাগরে তার সিংহাসন স্থাপন করে এবং সেখান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তার বাহিনী প্রেরণ করে। জাবির রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ إِبْلِيْسَ يَضَعُ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ، ثُمَّ يَبْعَثُ سَرَايَاهُ، فَأَدْنَاهُمْ مِنْهُ مَنْزِلَةً أَعْظَمُهُمْ فِتْنَةً
“ইবলিশ পানির উপর (অন্য বর্ণনায় সাগরে) তার সিংহাসন স্থাপন করত: তার বাহিনী প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে তার সর্বাধিক নৈকট্য প্রাপ্ত সেই, যে সর্বাধিক ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে।” (সহিহ মুসলিম)
এ ছাড়াও বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তারা ধোঁকা ও নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মানুষের ঘরে প্রবেশ করে, কখনো সাপের আকৃতিতে সেখানে বসবাস করে, বিসমিল্লাহ ছাড়া খাবার খেলে তাতে অংশ গ্রহণ করে, স্ত্রী সহবাসের দুআ না পড়লে স্ত্রী সহাবাসেও অংশ গ্রহণ করে, মানুষের সাথে চলাফেরা ও উঠাবসা করে, ওজুর সময় তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, সালাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, এমনকি তারা মানুষের দেহ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শিরায় শিরায় রক্ত প্রবাহের সাথে চলাফেরা করে। (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)
আমরা বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমিন।
▬▬▬◆◯◆▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।