কিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত হলো স্ত্রী তার স্বামীর ব্যবসা-বাণিজ্যে সাহায্য করবে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা

প্রশ্ন: “কিয়ামতের অন্যতম ছোট আলামত হলো, স্ত্রী তার স্বামীকে ব্যবসায় সহযোগিতা করবে”-এটা কি সঠিক? ব্যবসায় সাহায্য করাও কি কিয়ামতের লক্ষণ? বিষয়টি বুঝিয়ে দিলে উপকৃত হবো ইনশাআল্লাহ।

উত্তর: হ্যাঁ, উক্ত হাদিসটি সহিহ এবং এটি কিয়ামতের অন্যতম একটি ছোট আলামত।

নিম্নে এ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদান করা হলো: وبالله التوفيق

হাদিসে বলা হয়েছে, কিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত হলো যে, কিয়ামতের পূর্বে এত বেশি ব্যবসা-বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়বে যে, একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করবে। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إنَّ بين يَدَيِ الساعةِ فُشُوَّ التِّجارةِ حَتَّى تُعِينَ الْمَرأةُ زَوجَها على التِّجارةِ

“নিশ্চয় কিয়ামতের পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের এত ব্যাপকতা ঘটবে যে, স্ত্রী তার স্বামীকে ব্যবসা-বাণিজ্যে সহযোগিতা করবে।” [মুসনাদে আহমদ, ১/৪০৭, আল আদাবুল মুফরাদ, হাকিম, শুয়াইব আরনাবুত মুসনাদে আহমদ-এর তাহকিক গ্রন্থে এ হাদিসটিকে হাসান বলেছেন, হা/ ৩৮৭০ ও ৩৯৮২]

❑ হাদিসটির ব্যাখ্যা:

এ হাদিসে কিয়ামতের পূর্বে যে সব ছোট আলামত প্রকাশ পাবে সেগুলোর মধ্যে দুটি আলামতের কথা বলা হয়েছে। যথা:

১. কিয়ামতের পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক বিস্তার লাভ করবে।
২. নারীরা তাদের স্বামীদেরকে ব্যবসায়িক কর্মে সহায়তা করবে।

সুবহানাল্লাহ! আমরা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভবিষ্যতবাণীর বাস্তবতা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম উন্নতি, টিভি-চ্যানেলে বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক প্রচার-প্রসার এবং নিত্য-নতুন নানা আধুনিক প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের যুগে বিশ্ব অর্থনীতিতে অফলাইন-অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সর্বগ্রাসী রূপ পরিলক্ষিত হচ্ছে তা কল্পনাতীত। আই ফোন, স্মার্ট ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ অসংখ্য বাহনে ভর করে ইন্টারনেট এখন বিশ্ববাণিজ্যের লাইফ লাইন হয়ে উঠেছে। ফেসবুক-এর সূচনা, ইউটিউব, নেটফ্লিক্সসহ অসংখ্য গণমাধ্যম পুরো সিস্টেমে সত্যিকার অর্থেই বড় এক ঝাঁকুনি দিয়েছে। বিশেষ করে অনলাইনের যুগে একজন মানুষ ঘরে বসেই বিশ্ববাজারে বড় বড় ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

অনুরূপভাবে এটাও আমাদের অজানা নয় যে, বর্তমান যুগে অর্থনীতির এ বিশাল কর্মযজ্ঞে অনেক স্ত্রী তাদের স্বামীর ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা ও দেখভাল করে থাকে। অথচ সালাফদের যুগে এটি প্রচলিত ছিল না। কিন্তু আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী কিয়ামতের আলামত হিসেবে তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে।

আল্লাহর নবি কোনও কথা বলতেন না আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি মারফতে নির্দেশিত হওয়া ব্যতিরেকে-এ হাদিসটি তার আরেকটি উজ্জ্বল প্রমাণ। এটি তাঁর নবুওয়তের সত্যতারও প্রমাণ বহণ করে। আল হামদুলিল্লাহ।

❑ ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামীর ব্যবসা-বাণিজ্যে স্ত্রীর সাহায্য-সহযোগিতা করার বিধান কী?

শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে একজন স্ত্রী যদি তার স্বামীকে এ ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতা করে তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে তাতে কোনও দোষ নেই। ইসলাম ওয়েবে
উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,

وهذا وإن كان فيه بيان حال لم يكن معهوداً عند السلف وهو بيع وشراء النساء في التجارة؛ إلا أنه لا يدل على تحريم ذلك

“এ হাদিসে যদিও এমন একটা অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যেটা সালাফদের নিকট সুপরিচিত ছিল না। আর তা হলো, ব্যবসার ক্ষেত্রে নারীদের ক্রয়-বিক্রয়। তবে এ হাদিস এ কাজকে হারাম প্রমাণ করে না।”

এর মাধ্যমে নিঃসন্দেহে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে স্বামী উপকৃত হয় এবং পারিবারের ঘানি টানার ক্ষেতে একটা সাহায্যকারী মানুষ পেয়ে তার বোঝা হালকা হয়। যদিও তা স্ত্রীর মূল দায়িত্ব নয়। তার প্রধান দায়িত্ব হলো, স্বামীর সেবা করা, সন্তান প্রতিপালন করা এবং বাড়িতে অবস্থান করে স্বামীর সম্পদ হেফাজত করা। নিঃসন্দেহে এটা তার উপর অর্পিত অনেক বড় দায়িত্ব। পারিবারিক সুখ-শান্তি এবং সন্তান-সন্ততিকে সঠিকভাবে প্রতিপালনের স্বার্থে প্রতিটি নারীর এই দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করা কর্তব্য। এই সুখ-শান্তি পরিবার থেকে উঠে গেলে তা ধ্বংস হতে বাধ্য।

আর মনে রাখতে হবে যে, কিয়ামতের আলামত মানেই খারাপ কিছু নয়। কিছু কিছু কিয়ামতের আলামত অবশ্যই ভালো। যেমন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমন কিয়ামতের একটি আলামত। কারণ তিনি সর্বশেষ নবি। কিয়ামতের পূর্বে আর কোন নবির আগমন ঘটবে না। অর্থাৎ এর পরই কিয়ামত সংঘটিত হবে।

মোটকথা, একজন স্ত্রী যদি আল্লাহকে খুশি করার জন্য শরিয়তের সীমা রক্ষা করে স্বামী, সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের জরুরত মেটানোর ক্ষেত্রে স্বামীর ব্যবসায়িক কাজে কিছুটা অবদান রাখে তাহলে তা নাজায়েজ নয়। বরং এতে সে ইনশাআল্লাহ সওয়াব পাওয়া যাবে। যেমন: সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. দ্বীনের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় আয়-রোজগারের দিকে তেমন সময় দিতে পারতেন না। ফলে এতে তাদের সংসারের টানাপোড়ন চলতো। এজন্য তাঁর স্ত্রী সেলাইয়ের কাজ করে আয়-রোজগার করতেন এবং সংসারের খরচ চালাতেন।

❑ স্বামীর ব্যবসায়িক কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করা কখন হারাম?

একজন মুসলিম মহিলা যদি স্বামীর ব্যবসায় সহায়তার নামে আল্লাহর অবশ্য পালনীয় পর্দার বিধান লঙ্ঘন করে, পরপুরুষের সাথে অবাধে মেলামেশা করে, বাইরে বের হওয়ার সময় আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করে, পুরুষদের মত পোশাক-আশাক পরিধান করে, স্বামী বা মাহরাম পুরুষ ছাড়া ব্যবসায়িক কাজে দূর-দূরান্তে ছুটে বেড়ায় কিংবা স্বামীর হারাম ব্যবসা ও লেন-দেনে সাহায্য-সহযোগিতা করে তাহলে তা নিঃসন্দেহে হারাম। এমন কি কোনও ফাসেক বা দ্বীনের সঠিক জ্ঞান বঞ্চিত স্বামী যদি স্ত্রীকে এসব হারাম কাজের নির্দেশ প্রদান করে তাহলে স্ত্রীর জন্য তার নির্দেশ পালন করা বৈধ নয়।

বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান যুগে দেখা যাচ্ছে, অনেক মহিলা অর্থ বাজারে ইসলামি অনুশাসনকে উপেক্ষা করে পুরুষদের মতই পুরো দস্তুর ব্যবসায়িক হয়ে স্বামী, সন্তান ও সংসারকে জলাঞ্জলি দিয়ে বসেছে। যার ফলে ঘরে ঘরে অশান্তি, তালাক, পরকীয়া, নারী নির্যাতন, সন্তান-সন্ততির লেখাপড়া, স্বাস্থ্য এবং চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদির ভয়াবহ পরিণতি অবধারিত হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এই হাদিসের ইংগিত সম্ভবত: এ যুগের ওইসকল নারীবাদী স্ত্রীদের দিকে ইশারা করা হয়েছে, যারা ইসলামের পর্দা ব্যবস্থাকে ‘নারীর অধিকার হরণ’ বলে মনে করে এবং ‘চাকরি ও ব্যবসা বাণিজ্যে’র খোলা ময়দানে উন্মুক্তভাবে শরিক হয়ে দেখাতে চায় যে,

১. তারা তাদের ন্যায্য অধিকারকে কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে!
২. তারা সমাজের সামনে নমুনা হতে চায়, যাতে বাকি নারীরাও শরয়ি পর্দার অনধিকার চর্চাকে ছিন্ন করে বাড়ির বাইরে ব্যাপক হারে বেরিয়ে এসে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে!
(আল্লাহ এদের অনিষ্ট থেকে মুসলিম জাতিকে হেফাজত করুন। আমিন)

➧ উল্লেখ্য যে, একটা হাদিসে স্ত্রীদেরকে স্বামীর ব্যবসায় সাহায্য করাকে কিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত বিভিন্ন পাপ ও হারাম কাজের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু সনদগতভাবে তা সহিহ নয়। হাদিসটি হলো:

من اقتراب الساعة اثنتان وسبعون خصلة، إذا رأيتم الناس أماتوا الصلاة، وأضاعوا الأمانة، وأكلوا الربا…..، وشاركت المراة زوجها في التجارة،

আবু নুয়াইম তার আল-হিলইয়াহ গ্রন্থে (৩/৩৫৮)। শাইখ আলবানি বলেন, এ হাদিসটি দুর্বল। [দ্র. সিলসিলা যাইফাহ, হা/১১৭১]

আবু নুয়াইম বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওবায়েদ ইবনে ওমায়ের কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটি غريب। আমার জানা মতে, তার থেকে একমাত্র ফারাজ ইবনে ফুযালাহই বর্ণনা করেছেন।

শাইখ আলবানি বলেন, এ হাদিসটি দুর্বল যেমনটি হাফেজ ইরাকী বলেছেন। এ হাদিসের সনদে (উপরোক্ত সমস্যা ছাড়) দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এই যে, এটি মুনকাতি (অর্থাৎ সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে)। দ্র. জঈফ ও জাল হাদিস, ১/ বিবিধ]

✅ সারসংক্ষেপ:
১. কিয়ামতের পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক হারে বিস্তৃত হবে। এমন পরিস্থিতিতে এ ক্ষেত্রে মহিলারা তাদের স্বামীদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। এটি কেয়ামতের অন্যতম ছোট আলামত।
বর্তমান পরিস্থিতি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভবিষ্যৎ বাণীকে সত্য বলে প্রমাণ করে। যা তার নবুয়তের সত্যতার একটি প্রমাণ আলহামদুলিল্লাহ।

২. আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন। অতএব একজন স্ত্রী যদি এই হালাল কাজে শরিয়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে তার স্বামীকে সাহায্য করে তাহলে তাতে কোন দোষ নেই। হারাম তখন হবে যখন স্বামীকে ব্যবসায় সাহায্য করার নামে একজন মহিলা পর্দা লঙ্ঘন এবং অন্যান্য হারাম কর্মে লিপ্ত হবে। আল্লাহু আলাম।▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬

উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: