কাউকে জাহান্নামি বলার ভয়াবহতা এবং স্বামী যদি স্ত্রীকে এমন কথা বলে তাহলে স্ত্রীর কী করণীয়

প্রশ্ন: কোন স্ত্রী যদি সিয়াম পালন রত অবস্থায় হক কথা বলার কারণে তার স্বামী তাকে একাধিক বার বদদু্আ দেয় (তার অজ্ঞতার কারণে) “তুই জাহান্নামি”। তাহলে কি সত্যিই সে জাহান্নামে যাবে? জান্নাত-জাহান্নাম দেওয়ার একমাত্র মালিক তো শুধু আল্লাহ। বান্দা কে বলার? সে ক্ষেত্রে উক্ত স্ত্রীর কী করণীয় একটু বলবেন? উল্লেখ্য যে, উক্ত স্বামী তার স্ত্রীর মুখ নি:সৃত কোনও নসিহা কখন‌ই সহ্য করতে পারে না। আর স্ত্রীও হক কথা না বলে থাকতে পারে না।
উত্তর: একথা সঠিক যে, জান্নাত ও জাহান্নাম দেওয়ার একমাত্র মালিক আল্লাহ তাআলা। বান্দা কারও জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম নিশ্চিত করতে পারে না। কোনও ব্যক্তি যদি “তুই জাহান্নামি” বলে বদদুআ করে তা কখনোই আল্লাহর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে না। অর্থাৎ এ কারণে স্ত্রী জাহান্নামি হয়ে যাবে-একথা সঠিক নয়। এটা অবশ্যই একটি দুঃখজনক কথা এবং খারাপ আচরণ।

❑ স্ত্রীর সাথে খারাপ আচরণ করা, তাকে গালি দেওয়া ও তাকে বদদুআ দেওয়া কতটা নিকৃষ্ট কাজ?

◈ ১. কারও প্রতি বদদুআ করা ইসলামি আচার-আচরণে শোভন নয়। এ ধরণের আচরণ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র ও আদর্শ পরিপন্থী।

আনাস ইবনে মালিক রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,

لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَاحِشًا وَلاَ لَعَّانًا وَلاَ سَبَّابًا

“রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশালীন ভাষী, লানত কারী (অভিসম্পাত কারী) ও গালিবাজ ছিলেন না।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), অধ্যায়: ৭৮/ আচার-ব্যবহার, পরিচ্ছেদ: ৭৮/৪৪. গালি ও অভিশাপ দেওয়া নিষিদ্ধ]

◈ ২. বিশেষ স্ত্রীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে এমন কথাবার্তা আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘণ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদর্শ পরিপন্থী বিষয়।

❂ আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّـهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا

“নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।” [সূরা নিসা: ১৯]

❂ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

« لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً ( أي : لا يبغض و لا يكره ) إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ »

“কোন মুমিন পুরুষ কোনও মুমিন নারীকে ঘৃণা ও অপছন্দ করবে না; যদি সে তার কোনও স্বভাবকে অপছন্দ করেও, তাহলে সে তার অপর একটি স্বভাবকে পছন্দ করবে।” [সহিহ মুসলিম]

❂ তিনি আরও বলেন,

اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ ، فَإِنَّ المَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَيْءٍ فِي الضِّلَعِ أَعْلاَهُ ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ ، فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ

‘‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে। কেননা মহিলাকে বাম পাঁজরের হাড় হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড় সবচেয়ে বাঁকা হয়। যদি তুমি তা সোজা করতে চেষ্টা কর তাহলে তা ভেঙ্গে যাবে। আর যদি সেভাবেই ছেড়ে দাও তাহলে সর্বদা বাঁকাই থাকবে। সুতরাং তাদের সাথে সৎ ব্যবহার করতে থাক।’’ [সহিহ বুখারি, হা/৩০৮৪]

❑ কাউকে ‘তুই জাহান্নামি’ বলা কবিরা গুনাহ:

‘আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন না’, ‘আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করবেন না’, ‘তুই জান্নাতে যাবি না’, ‘তুই জাহান্নামে যাবি’ ‘তুই জাহান্নামি’ নির্দিষ্টভাবে কোনও ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে এ জাতীয় কথাবার্তা বলা কবিরা গুনাহ (বড় পাপ)। কেননা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর এটা উপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া এবং আল্লাহর ব্যাপারে অনধিকার চর্চার শামিল। তা ছাড়া এটি আল্লাহর দয়াশীলতা ও ক্ষমার প্রতি অজ্ঞতারও বহিঃপ্রকাশ।

হাদিসে এসেছে, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

أنَّ رَجُلًا قالَ: واللَّهِ لا يَغْفِرُ اللَّهُ لِفُلانٍ، وإنَّ اللَّهَ تَعالَى قالَ: مَن ذا الذي يَتَأَلَّى عَلَيَّ أنْ لا أغْفِرَ لِفُلانٍ، فإنِّي قدْ غَفَرْتُ لِفُلانٍ، وأَحْبَطْتُ عَمَلَكَ، أوْ كما قالَ

“জনৈক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করল, যে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। তার এ মন্তব্য শুনে আল্লাহ তাআলা বললেন, “এমন কে আছে যে আল্লাহর উপর আগ বাড়িয়ে কসম করে বলে যে, তিনি উমুককে ক্ষমা করবেন না। আমি ঐ ব্যক্তিকেই ক্ষমা করে দিলাম আর তোমার সমস্ত আমল বাতিল করে দিলাম।” [সহিহ মুসলিম]

❑ স্বামীর কর্তব্য:

◆ ১. স্ত্রী যদি তাকে কোনও ভালো উপদেশ, সৎ পরামর্শ বা ভুল সংশোধনী দেয় তাহলে তার কর্তব্য, স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তা গ্রহণ করা। কেননা প্রকৃত বন্ধু ও কল্যাণকামী সেই যে আপনার ভুলগুলো ধরিয়ে দেয় এবং আপনার কল্যাণের জন্য সদুপদেশ দেয়।
মনে রাখতে হবে, কেউ যদি হক বা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তা হলো, অহংকারের আলামত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

الكِبْرُ : بَطَرُ الْـحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ

“অহংকার হল, সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা।” [সহিহ মুসলিম]

আর অহংকারের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لاَ يَدْخُلُ الْـجَنَّةَ مَنْ كَانَ في قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ

“যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” [সহিহ মুসলিম]

এ ছাড়াও কুরআনের অনেক আয়াত ও হাদিসে অহংকারীর ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখিত হয়েছে।

◆ ২. স্বামীর জন্য আরও করণীয় হলো, নিজের অসংলগ্ন আচরণ ও এমন জঘন্য কথা বলার কারণে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার পাশাপাশি স্ত্রীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। ভুল করার পর স্ত্রীর নিকট ক্ষমা চাইলে স্বামীর সম্মান ক্ষুণ্ণ হয় না বরং স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা, সম্মান ও আস্থা বৃদ্ধি পায়। এটা সুখ-শান্তিপূর্ণ দাম্পত্য এবং একটা সুন্দর পরিবারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

❑ স্বামীর এহেন আচরণে স্ত্রীর করণীয়:

❂ ১. সবর বা ধৈর্য ধারণ করা: স্ত্রীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্বামীর খারাপ আচরণ এবং অশালীন শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া। স্বামীর কাছ থেকে এমন কথা শোনার পর, তার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হওয়া বা প্রতিক্রিয়া দেখানোর পরিবর্তে শান্ত থেকে পরিস্থিতি সামলানোটা গুরুত্বপূর্ণ।

মহান আল্লাহ সবর কারীকে অপরিসীম পুরষ্কারে ভূষিত করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ

“ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেওয়া হবে কোন হিসাব ছাড়াই।” [সূরা যুমার: ১০]

তিনি আরও বলেন,

وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ

“আর তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” [সূরা আনফাল: ৪৬]

তাছাড়া রাগ নিয়ন্ত্রণকারীদের সম্পর্কেও আল্লাহ প্রশংসা করেছেন। এটিকে তিনি মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দেখুন: সূরা আলে ইমরান-এর ১৩৪ নাম্বার আয়াতের ব্যাখ্যা।

❂ ২. স্বামীর পরিবর্তনের জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করা:

স্ত্রীর উচিত স্বামীর জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা যেন, আল্লাহ তাকে হেদায়েত দেন এবং সংশোধন করে দেন। একজন ইমানদার স্ত্রী কখনও স্বামীর জন্য বদদুআ করবেন না বরং তাকে ভালোর দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য দুআর পাশাপাশি চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। আল্লাহ মানুষের মনের নিয়ন্ত্রণ কারী। সুতরাং দুআর বরকতে হয়ত তিনি তার বক্র অন্তরকে পরিবর্তন করে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

❂ ৩. গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সময় সতর্কতা অবলম্বন:

স্ত্রীর উচিত, এমন সময় হক কথা বলার চেষ্টা করা যখন স্বামী সুস্থ মস্তিষ্কে মনোযোগ দিয়ে কথা শুনতে প্রস্তুত থাকেন। যদি স্বামী নসিহা (উপদেশ) গ্রহণ করতে না চান তবে পরিস্থিতি ও সময় বুঝে নরম ভাষায় কথাগুলো বলার চেষ্টা করা উচিত। এ ছাড়া, মাঝে মাঝে সরাসরি না বলে এমন পন্থায় কথা বলা যেতে পারে যাতে তার কাছে সঠিক বার্তাটা পৌঁছানো যায় কিন্তু স্বামী ক্ষুব্ধ না হন।

৪. স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা:

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যত ভালো হবে, ততই সুন্দরভাবে হক কথা বলার সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করা যায়। তাই একে অপরের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ।

অবশ্য এ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকা কর্তব্য।

পরিশেষে বলব, স্বামী যদি স্ত্রীকে অন্যায়ভাবে ‘তুই জাহান্নামি’ বা ‘জান্নাত তোর জন্য হারাম’ কিংবা এ জাতীয় কথা বলে তাহলে তার এসব বদদুআ বা হারাম কথাবার্তার কারণে স্ত্রীর জীবনে কোনও প্রভাব ফেলবে না। কারণ আল্লাহই বান্দার শেষ পরিণতির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকারী; কোনও মানুষ নয়। আল্লাহ কাকে ক্ষমা করবেন আর কাকে করবেন না-এটা একান্তই তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কোনও মানুষ তা জানে না কার পরিণতি কী হবে। বরং এ কারণে স্বামী নিজেই গুনাহগার বলে সাব্যস্ত হবে। তবে স্ত্রীর উচিত, তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা, সর্বোচ্চ ধৈর্যের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে পারিবারিক বিষয়গুলো সমাধান করার চেষ্টা করা এবং স্বামীর হেদায়েতের জন্য দুআ করা। নিশ্চয় আল্লাহ হেদায়েতের মালিক। আল্লাহু আলাম।

▬▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: