এক নজরে মৃত, কবর ও মাজার বিষয়ক ৩০টি করণীয় ও বর্জনীয়

প্রশ্ন: মৃত ব্যক্তির প্রতি জীবিতদের করণীয়-বর্জনীয় বিষয়গুলো জানতে চাই।
উত্তর: মানুষ মারা গেলে তাদের প্রতি জীবিতদের কতিপয় করণীয় রয়েছে-যে সব ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এর বিপরীতে মানুষের মনগড়া ও সুন্নাহ বহির্ভূত অনেক বিষয় আমাদের সমাজে একেক স্থানে একেকভাবে এমনভাবে শিকড় গেঁড়ে বসেছে যে, এখন সেগুলোকে চিহ্নিত করাই কঠিন হয়ে গেছে। বর্তমানে প্রকৃত ইলমে নব্বীর আলোকবর্তিকা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে এ সব ভ্রান্ত, বানোয়াট ও বিদআতগুলোকেই মানুষ সুন্নাহ ভাবতে বসেছে!
আর এ কথাও অনিস্বকার্য যে, এসব বিদআত ও বানোয়াট বিষয়গুলোর আমাদের সমাজে একশ্রেণীর পেট পূজারী, স্বার্থান্বেষী ও অর্থলোভী মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। যার কারণে তারা কোনভাবেই সেগুলো হাতছাড়া করতে রাজি নয়। আর তাই তো এগুলোর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চাইলে তারা তেড়ে মারতে আসে! আর কিছু বিষয় হয়ত দলিলের বুঝের পার্থক্যের কারণে দ্বিমত পূর্ণ। যাহোক, নিম্নে মৃত ব্যক্তির প্রতি জীবিতদের করণীয়-বর্জনীয় বিষয়গুলো সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হল।
◈ মৃত ব্যক্তির প্রতি করণীয় সমূহ: (১৫টি)
১) মৃতের খবর শুনে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পাঠ করা।
২) যথাসম্ভব দ্রুত গোসল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।
৩) কাফন পরানো।
৪) জানাজার সালাত আদায় করা।
৫) দাফন সম্পন্ন করা।
৬) অত:পর আল্লাহর কাছে দুআ করা যেন আল্লাহ তাআলা তাকে কবরের সওয়াল জওয়াবের সময় দৃঢ় ও স্থির রাখেন। (প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে দুআ করবে; সম্মিলিতভাবে নয়)
৭) পাশাপাশি তার জন্য আল্লাহর নিকট রহমত, মাগফিরাত ও কবরের আজাব থেকে পরিত্রাণের দুআ করা।
৮) মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দান-সদকা করা।
৯) মৃত ব্যক্তির ঋণ থাকলে ওসিয়ত বাস্তবায়ন ও ওয়ারিশদের মাঝে বণ্টনের আগে তার সম্পদ থেকে ঋণ পরিশোধ করা।
১০) তার বৈধ ওসিয়ত বাস্তবায়ন করা। তবে মৃত ব্যক্তি যদি এমন অসিয়ত করে যা মূলত: হারাম বা যা পালন করা কষ্টসাধ্য বা আদৌ সম্ভব নয় বা তাতে ওয়ারিশদের ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে তাহলে তা পূরণ করা জরুরি নয়।
১১) অত:পর ওয়ারিশদের মাঝে কুরআন-সুন্নাহর বিধান অনুযায়ী সম্পদ বণ্টন করা।
১২) হজ্জ ফরজ হওয়ার পর বার্ধক্য বা অসুস্থতা জনিত কারণে তা আদায় করতে না পারলে তার পক্ষ থেকে বদলি হজ্জ-উমরা আদায় করা, মানত থাকলে পূরণ করা, ফরজ রোজা বাকি থাকলে তার সম্পদ থেকে প্রতিটি রোজার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে খাওয়ানো (মতান্তরে ওয়ারিশগণ কর্তৃক রোজা রাখা) আর মানতের রোজা থাকলে ওয়ারিশগণ কর্তৃক রোজা রাখা।
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নফল হজ্জ বা উমরা করাও বৈধ। তবে ফরজ হজ্জ-উমরা হোক বা নফল হোক যে ব্যক্তি তার পক্ষ থেকে আদায় করবে তার নিজেরটা আগে সম্পাদন করা আবশ্যক।
১৩) মৃত ব্যক্তির স্ত্রী গর্ভবতী না হল ৪ মাস ১০ দিন আর গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত ইদ্দত পালন করা।
১৪) নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের কর্তব্য, মৃতের বাড়িতে ৩ দিন পর্যন্ত খাবার রান্না করে পাঠানো। এটি মূলত: তাদের বেদনা বিধুর পরিবেশে সমবেদনা প্রকাশ ও সহযোগিতার অন্তর্ভুক্ত। তবে এ তিন দিন মৃতের বাড়িতে আগুন জ্বালানো যাবে না বা কিছু রান্না করা যাবে না এ কথা সঠিক নয়। দরকার হলে তারা নিজেরাও রান্না-বান্না করতে পারে।
১৫) মৃত ব্যক্তির পরিবার বর্গের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ ও সান্ত্বনা প্রদান।
◈ মৃত ব্যক্তি ও কবর-মাজার সংক্রান্ত বর্জনীয় বিষয় সমূহ: (১৫টি)
১) একান্ত জরুরি কোন কারণ ছাড়া কাফন-দাফন বিলম্ব করা উচিৎ নয়।
২) অনুরূপভাবে মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে দূর-দূরান্তে দীর্ঘ সময় মাইকিং করাও উচিৎ নয় বরং জানাজার সময় জানানো এবং দাফনে অংশ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে স্থানীয় লোকজনকে সংবাদ দেয়ায় যথেষ্ট। একান্ত জরুরি হলে সামান্য কিছু মাইকিং করা যেতে পারে।
৩) কারও মৃত্যুর পর পর তার স্ত্রী-পরিবার ও সন্তান সন্তান-সন্ততিদের চিৎকার করে কান্নাকাটি করা, মাতম করা, কাপড় ছেঁড়া, মাথার চুল ছেঁড়া, শরীরে আঘাত করা, মাটিতে গড়াগড়ি করা ইত্যাদি হারাম কাজ ও জাহিলিয়াতের রীতিনীতি।
বরং এ ক্ষেত্রে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন’ পাঠ করতে হবে এবং ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
অবশ্য নীরবে-নিভৃতে সামান্য কিছু ক্রন্দন করা বা প্রিয়জন হারানোর বেদনায় দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়া দোষিণীয় নয়।
এ ছাড়া আরও যে সব কাজ শরিয়ত বহির্ভূত ও বিদআত রয়েছে সেগুলো হল:
৪) লাশের চারপাশে বসে কুরআন তিলাওয়াত করা (সূরা ইয়াসিন পাঠের হাদিস জইফ)।
৫) মৃত ব্যক্তির নামাজের কাফফারা হিসেবে তার ওয়ারিশদের নিকট চাল, ডাল বা টাকা-পয়সা আদায় করা।
৬) লাশ দাফনের পরে সম্মিলিত দুআ-মুনাজাত করা।
৭) গোসল, জানাজা ও দাফন ক্রিয়ায় অংশ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের নাম লিস্ট করে ৩য় দিনে বিশেষভাবে তাদের জন্য ভোজ সভার আয়োজন করা।
৮) যে স্থানে মৃত ব্যক্তির লাশ ছিল সে স্থানে ৪০ দিন পর্যন্ত আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি জ্বালিয়ে রাখা।
৯) মারা যাওয়ার ৪০তম দিনে চল্লিশা পালন করা।
১০) মৃত বার্ষিকী, ওরস, কুলখানি, মিলাদ মাহফিল ও ইসালে সওয়াব বা সওয়াব রেসানি অনুষ্ঠান করা।
১১) কুরআন খতম বা শবিনাখানি করার পর মৃত ব্যক্তির কবরে সওয়াব বখশানো।
১২) কবরকে অতিরিক্ত উঁচু করা, পাকা করা, কবরকে সুরম্য প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টন করা, কবরের দেয়ালে চুনকাম করা, তাতে কুরআনের আয়াত, বিভিন্ন উপদেশ মূলক বাণী বা মৃতের পরিচিতি ইত্যাদি লেখা, কবরের দেয়ালে চুমু খাওয়া, মসজিদের মধ্যে কবর দেয়া, কবরের উপর শামিয়ানা বা ছাদ দেয়া, কবরে ফ্যান বা এসি স্থাপন করা, কবরের মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বলানো ইত্যাদি সব হারাম।
১৩) নির্দিষ্ট দিনে কবর জিয়ারতের জন্য একত্রিত হওয়া। যেমন: জুমার দিন, কথিত শবে বরাতে, শবে কদরে, দু ঈদের রাত ইত্যাদি।
এগুলো সব দ্বীনের মধ্যে নব আবিষ্কৃত বিদআত-যা আমাদের সমাজের ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। এগুলো অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
১৪) কবরে শায়িত নবী বা অলি-আউলিয়ার উদ্দেশ্যে মান্নত পেশ করা, পশু জবেহ করা, তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা, কবরকে উদ্দেশ্য করে সেজদা দেয়া, রোগমুক্তি কামনা করা, বিপদাপদে উদ্ধার কামনা করা, তাদেরকে ওসিলা মনে করা, তাদের উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা ইত্যাদি শিরক।
১৫) মৃত ব্যক্তির কফিন বা তার কবরের উদ্দেশ্যে ফুল দেয়া, স্যালুট দেয়া বা শ্রদ্ধা নিবেদন করা অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সুতরাং নি:সন্দেহে এগুলো হারাম ও অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার এবং বিদআত থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।
Share: