এক ঘণ্টা দীনি ইলম চর্চা করা বা আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ষাট বছর নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ সংক্রান্ত হাদিস কি সহিহ?

প্রশ্ন: নিম্নোক্ত দুটি হাদিস সম্পর্কে জানতে চাই:
১) “কেউ যদি এক ঘণ্টা দীনি ইলম চর্চা করে তাহলে তাঁকে ষাট বছর নফল এবাদত করার সওয়াব দেয়া হয়।”
২) “এক ঘণ্টা চিন্তা-ভাবনা করা ষাট বছরের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।”

উত্তর:
❑ ১ম বিষয়: “কেউ যদি এক ঘণ্টা দীনি ইলম চর্চা করে তাহলে তাঁকে ষাট বছর নফল এবাদত করার সওয়াব দেয়া হয়।” [এটি হাদিস নয় বরং ইবনে উমর রা. এর উক্তি। কিন্তু সনদগতভাবে তা দুর্বল]

ফিরদাউসে দায়লামিতে বর্ণিত হয়েছে,
مجلس فقه خير من عبادة ستين سنة
“জ্ঞানের একটি বৈঠক ষাট বছরের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।”

◈ বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের মতে, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখনিঃসৃত হাদিস নয় (মারফু হাদিস নয়) বরং ইবনে উমর রা. এর একটি উক্তি। (মাওকুফ হাদিস)। কিন্তু সনগতভাবে তা জইফ (দুর্বল)। যেমনটি খতিব বাগদাদি রহঃ তার বিখ্যাত ‘কিতাবুল ফকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ গ্রন্থে যইফ সনদে উল্লেখ করেছেন।

◈ অনুরূপভাবে ‘বানোয়াট এবং দুর্বল হাদিস ও আসার’ বিশ্বকোষ (موسوعة الأحاديث والآثار الضعيفة والموضوعة ) গ্রন্থে এ হাদিসটিকে যইফ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে এটা ঠিক যে, ব্যক্তিগতভাবে নফল ইবাদতের চেয়ে জ্ঞানচর্চা অধিক মর্যাদা পূর্ণ কাজ। কারণ একজন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে নফল ইবাদত-বন্দেগি করলে সে নিজে উপকৃত হয় কিন্তু জ্ঞানচর্চা ও মানুষকে দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা দানের মাধ্যমে নিজে উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য মুসলিমগণও উপকৃত হয়, আল্লাহর দীনের প্রচার ও প্রসার হয়। যার ফলাফল হয় ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী। আর সে কারণেই হাদিসে একজন ইলমহীন ইবাদতকারীর চেয়ে একজন আলেমের মর্যাদা বেশি বলা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ
“আলেমগণের মর্যাদা আবেদগণের উপরে ঐরূপ, পূর্ণিমা রাতে চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকাসমূহের উপরে যেরূপ।” (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারেমি, মিশকাত হা/২১২ ‘ইলম’ অধ্যায়।)

মোটকথা, দীনের জ্ঞান চর্চা করার মর্যাদা সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরিমাণ কুরআনের আয়াত ও সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে আল হামদুলিল্লাহ। সেগুলাই যথেষ্ট। সুতরাং এর মর্যাদা প্রমাণের জন্য এসব অপ্রমাণিত কথাবার্তার আদৌ প্রয়োজন থাকতে পারে না।

উল্লেখ্য যে, দায়লামি গ্রন্থটিতে প্রচুর পরিমাণে জাল ও যইফ হাদিস বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণের মতামতের আলোকে হাদিসের মান সম্পর্কে না জেনে এই কিতাবটি থেকে হাদিস গ্রহণ নিরাপদ নয়।
••••••••••••••••••••
❑ ২য় বিষয়: “এক ঘণ্টা চিন্তাভাবনা করা ষাট বছরের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।” (বানোয়াট হাদিস)

উপরোক্ত হাদিসটি মুহাদ্দিসগণের গবেষণায় বানোয়াট এবং হাদিসের নামে মিথ্যাচার। হাদিসটি হল,
فكرةُ ساعةٍ خيرٌ من عبادةِ ستِّين سنةً
“এক ঘণ্টা চিন্তা-ভাবনা করা সত্তর বছরের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।” এটি বানোয়াট হাদিস।

◯ মুহাদ্দিসগণের অভিমত:

◈ ইবনুল জাউযি বলেন, لا يصح ، وفي الإسناد كذابان “এ হাদিসটি সহিহ নয়। এর সনদে দু জন মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারী আছে।” (মাওযুআতে ইবনুল জাউযি ৩/৩৮৬)
◈ ইমাম যাহাবি বলেন, فيه إسحاق بن نجيح : كذاب “এর সনদে ‘ইসহাক বিন নুজাইহ’ নামক একজন মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারী আছে।” (তারতীবিল মাউযুআত/২৬৯)
– এই ইসহাক বিন নুজাইহ এর ব্যাপারে ইমাম আহমদ বলেন, هو أكذب الناس “সে সবচেয়ে বড় মিথ্যুক।”
– ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন বলেন, معروف بالكذب ووضع الحديث”সে মিথ্যা ও হাদিস বানানোর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ।”
◈ সাফফারিনি বলেন, إسناده واه بل موضوع “এর সনদটি উদ্ভট বরং বানোয়াট।”
◈ শাওকানি বলেন, في إسناده كذابان “এ হাদিসের সনদে দু জন মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারী আছে।” (আল ফাওয়ায়েল মাজমুআহ/২৪২)
◈ আলবানি বলেন, এটা موضوع (বানোয়াট)। [যইফুল জামে/৩৯৮৮]

তবে নি:সন্দেহে আসমান, জমিন, পৃথিবী এবং বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তাভাবনা করা আল্লাহর পরিচয় লাভের উপায়। তাই কুরআন হাদিসে এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত উৎসাহ মূলক বক্তব্য এসেছে। যেমন:
-মহান আল্লাহ বলেন,
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّـهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَـٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
“যারা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচাও।” (আলে ইমরান: ১৯১)

– তিনি আরও বলেন,
أَفَلَا يَنظُرُونَ إِلَى الْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ, وَإِلَى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ, وَإِلَى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ, وَإِلَى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ
“তারা কি উটের প্রতি লক্ষ্য করে না যে, তা কিভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে? আকাশের প্রতি লক্ষ্য করে না যে, তা কিভাবে উচ্চ করা হয়েছে? পাহাড়ের দিকে যে, তা কিভাবে স্থাপন করা হয়েছে? এবং পৃথিবীর দিকে যে, তা কিভাবে সমতল বিছানো হয়েছে?” (সূরা গাশিয়া: ১৭-২০)

মূলত: আল্লাহ সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তাভাবনা করা নি:সন্দেহে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অপার শক্তিমত্তা, অভূতপূর্ব সৃষ্টি কুশলতা ও শৈল্পিকতা, সমগ্র সৃষ্টি লোকের উপর তার একচ্ছত্র আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ এবং তার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও জ্ঞান লাভ করা যায়। ফলশ্রুতিতে আমাদের মস্তক তার তাওহীদ বা একত্ববাদের সামনে নত হতে বাধ্য হয়।

মোটকথা, আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা প্রসঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ কুরআন ও সহিহ হাদিস বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং এসব জাল ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা দ্বারা ওয়াজ করা, বয়ান করা এবং এগুলো এখানে-সেখানে প্রচার-প্রসার করা থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা অপরিহার্য। জেনেশুনে কেউ এমনটি করলে তার পরিণতি হবে জাহান্নাম-যেমনটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্তক করে দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◈◯◈▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: