ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়াবি বিষয়ে পড়াশোনার গুরুত্ব কতটুকু?

ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়াবি বিষয়ে পড়াশোনার গুরুত্ব কতটুকু?
▬▬▬▬◆◈◆ ▬▬▬▬
الحمد لله والصلاة و السلام على رسول الله أما بعد:
মহান আল্লাহর রীতি হল, তিনি এ পৃথিবীর নেতৃত্ব ও পরিচালনার ভার তাদের হাতেই তুলে দেন যারা এটিকে সুন্দরভাবে পরিচর্যা ও পরিচালনা করতে পারবে। আর পৃথিবীকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য দুনিয়াবি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করা জরুরি।

সুতরাং বিশ্বকে দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব প্রদান ও পরিচালনার জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, গণিত, সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, সাংবাদিকতা, অর্থনীতি, কৃষি, নির্মাণ, রসায়ন, প্রাণীবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, নভোপদার্থবিদ্যা, সৌরপদার্থবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানী ও দক্ষ মানুষের প্রয়োজন। এসব বিদ্যায় যদি মুসলিমরা অগ্রগামী না হয় তাহলে তাদেরকে অমুসলিমদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে আর অন্যের প্রতি মূখাপেক্ষী থেকে কখনোই বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়। ইতিহাস সাক্ষী, একসময় আমাদের পূর্বসূরিরা ইসলামি জ্ঞানের পাশাপাশি পার্থিব জ্ঞান, বিজ্ঞান চর্চা ও নানা আবিষ্কারের মাধ্যমে পৃথিবীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

আল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা আনফাল: ৬০)। সুতরাং মুসলিমরা যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় অগ্রগামী না হয় তাহলে কিভাবে তারা যুদ্ধের সরঞ্জাম আবিষ্কার, নির্মাণ বা পরিচালনা করবে?
আল্লাহর নবী জাকারিয়া আ. একজন কার্পেন্টার (রাজমিস্ত্রি) ছিলেন, দাউদ আ. একজন কামার ছিলেন। তিনি লোহা দ্বারা নানা যুদ্ধাস্ত্র, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদি তৈরি করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর সাহাবিগণ ও তাবেঈদের অনেকেই বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতের উপার্জন কৃত খাবারকে সবচেয়ে পবিত্র খাবার হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

মিকদাম রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‏ مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ دَاوُدَ ـ عَلَيْهِ السَّلاَمُ ـ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ ‏”‏‏
“নিজ হাতে উপার্জিত জীবিকার খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আলাইহিস সালাম) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন।” [সহিহ বুখারি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ২৬/ ক্রয়-বিক্রয়, পরিচ্ছেদ: ১২৯১. লোকের উপার্জন এবং নিজ হাতে কাজ করা]

আর এ কথায় কোনও সন্দেহ নাই যে, দুনিয়াবি যে কোনও কাজ সুচারু রূপে সম্পন্ন করতে হলে বা কোন কাজ দ্বারা জীবিকা উপার্জন করতে হলে সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। এখান থেকে দুনিয়াবি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা করা যায়।

❑ পার্থিব বিষয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে কিভাবে ইবাদতে পরিণত করা যায়?

শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. বলেন,
تعلم العلوم الدنيوية أمرٌ مفيدٌ ونافعٌ، بشرط ألا يشغل عن علم الآخرة وعمَّا ينفعه في الآخرة، فإن جمع بينهما فقد جمع خيرًا إلى خيرٍ، وإن صلحت نيته في علوم الدنيا كانت عبادةً، وإذا تعلَّمها للدنيا فليس له ولا عليه، تعلم شيئًا مباحًا، لا حرج عليه.
“পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখা একটি উপকারী বিষয়। তবে শর্ত হল, তা যেন আখিরাতের জ্ঞান এবং আখিরাতে যা তার উপকার করবে তা থেকে বিচ্যুত না করে। সে যদি উভয় প্রকার জ্ঞানের মাঝে সমন্বয় করে তাহলে ভালোর সাথে ভালোর সমন্বয় করলো। যদি এই দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার নিয়ত সঠিক হয় (অর্থাৎ ইসলাম ও মুসলিমদের উপকার করার নিয়ত করে) তবে তা ইবাদতে পরিণত হবে আর যদি কেবল পার্থিব উদ্দেশ্যেই শেখে তাহলে তা তার পক্ষে বা বিপক্ষে কোনটাই নয়। সে একটা বৈধ জিনিস শিখল। এতে তার কোনও দোষ নেই।”

বুঝা গেল, কেউ যদি পার্থিব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমদের উপকার করার নিয়ত করে তাহলে তা ইবাদতে পরিণত হবে। এর মাধ্যমে সে সওয়াব লাভ করবে। কিন্তু এই নিয়ত না থাকলে নেকি বা গুনাহ কোনটাই নাই। তবে এখানে একটি শর্ত হল, পার্থিব জ্ঞান বাস্তব জীবনে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শরিয়া বিরোধী কোন কাজে ব্যবহার করা জায়েজ নয়। অন্যথায় গুনাহগার হবে।
যেমন: কেউ যদি অর্থনীতি বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞানার্জন করে বাস্তব জীবনে সুদী কার্যক্রম করে তাহলে সে গুনাহগার হবে। কেউ যদি সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ করে বা মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম করে তাহলে সে গুনাহগার হবে। কোন শিক্ষক যদি ছাত্রদেরকে নাস্তিকতা ও শরিয়া বিরোধী শিক্ষা দেয় তাহলে সে নিজে গুনাহগার হওয়ার পাশাপাশি এর মাধ্যমে উপার্জিত অর্থও তার জন্য হারাম বলে গণ্য হবে। (নাউযুবিল্লাহ)

❑ জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে মানুষ কখন গুনাহগার হবে?

মনে রাখা আবশ্যক যে, সর্বাবস্থায় প্রত্যেক মুসলিমদের জন্য ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা ফরজ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
طَلَبُ العِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَىْ كُلِّ مُسْلِمٍ
“ইলম (শরিয়া সংক্রান্ত জ্ঞান) অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ।” (সহিহুল জামে-আলবানি হা/৩৯১৪)

সুতরাং কেউ যদি কেউ দুনিয়াবি জ্ঞানার্জন করতে গিয়ে দীনের জ্ঞান অন্বেষণে অমনোযোগী থাকে বা দীনকে উপেক্ষা করে চলে তাহলে সে ফরজ লঙ্ঘন করার কারণে গুনাহগার হবে এবং এই দুনিয়ার জ্ঞান তার জন্য আখিরাতে ধ্বংসের কারণ হবে। কিন্তু সে যদি দ্বীন ও দুনিয়া উভয় বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে তাহলে সে উভয় দিক থেকে লাভবান হল। এটাই সবচেয়ে উত্তম-যেমনটি শাইখ বিন বায রহ. এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে।

দুআ করি, মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামি শরিয়া বিষয়ক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি দুনিয়ার যা কিছু কল্যাণকর তা শিখে তার মাধ্যমে হালালভাবে জীবিকা উপাজর্নের পাশাপাশি মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারি। নিশ্চয় আল্লাহ পরম দয়ালু ও প্রজ্ঞাবান।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◆◈◆ ▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: