প্রশ্ন: বলা হয়, “দুনিয়ার বেশি গভীরে প্রবেশ করো না; বের হতে পারবে না। দুনিয়ার মোহে পড়ে গেলে আল্লাহ প্রেমের স্বাদ পাবে না।” প্রশ্ন হল, প্রেম শব্দটি কি আল্লাহর সাথে ব্যবহার করা জায়েজ আছে? তৎসঙ্গে এই ক্ষেত্রে ইশক এবং মহাব্বত শব্দের ব্যবহারের বিধান জানতে চাই।
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর:
❑ ১. ইশক/এশক শব্দের ব্যবহার:
আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের শানে ইশক/এশক (عشق) শব্দ ব্যবহার করা জায়েজ নেই। কারণ বাড়াবাড়ি পর্যায়ের প্রবল আকর্ষণ ও তীব্র আকাঙ্ক্ষা যুক্ত ভালোবাসাকে ‘ইশক’ বলা হয়।
ইবনুল মনজুর রহ. ‘লিসানুল আরব’ শীর্ষক আরবি অভিধানে বলেন,
العِشْقُ فرط الحب وقيل هو عُجْب المحب بالمحبوب يكون في عَفافٍ الحُبّ ودَعارته
“বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ভালবাসাকে ইশক বলা হয়।” আরও বলা হয়েছে, ইশক হলো, প্রেয়সীর প্রতি প্রেমিকের অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হওয়া-চাই প্রেম-ভালবাসা পবিত্র হোক অথবা অপবিত্র।’
আরও বলা হয়েছে,
عشِق الشَّيءَ :هوِيه وتعلّق قلبُه به وأحبَّه حبًّا شديدًا
“ইশক হলো, কোনও কিছুর প্রতি আবেগ সহকারে অন্তর লেগে থাকা এবং তাকে তীব্রভাবে ভালবাসা।” [kalimmat]
এ স্তরের ভালবাসা আল্লাহ তাআলার
ও তাঁর রসূলের জন্য সাব্যস্ত করা বৈধ নয়। তাই বান্দার অন্তরে আল্লাহর প্রতি যে ভালোবাসা থাকে, তাকেও ইশক নাম দেওয়াও যাবে না।
এ শব্দটি কুরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের মুখে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশার্থে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি।
মূলত: ভ্রান্ত সুফি পন্থী ও বিদআতিরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শানে এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। যেমন: তারা বলে থাকে, আশেকে রসুল, চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক রচিত ‘আশেক-মাশুক বা এস্কে এলাহী’ নামে একটি বই রয়েছে। আমাদের সমাজে অনেক মানুষের নাম দেখা যায় ‘আশেকে এলাহি/আশেকে খোদা’। (এমন নাম রাখা নাজায়েজ।)
ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কায়েম প্রমুখ মুহাক্বিক আলিমগণ এ ক্ষেত্রে উক্ত শব্দটি ব্যবহারের বিরোধিতা করেছেন। [মাদারিজুদ সালিকিন]
ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন,
ولما كانت المحبة جنسا تحته أنواع متفاوتة في القدر والوصف، كان أغلب ما يذكر فيها في حق الله تعالى ما يختص به ويليق به، كالعبادة والإنابة والإخبات، ولهذا لا يذكر فيها العشق والغرام والصبابة والشغف والهوى.. وقد يذكر لفظ المحبة كقوله تعالى: يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَه [المائدة: 54]
“মোহাব্বত (ভালোবাসা) শব্দটি হল, একটি জাতিবাচক বিশেষ্য। এর অধীনে পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে নানা ধরণের ভিন্নতা রয়েছে। এই জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে আল্লাহর শানে তার জন্য যা নির্ধারিত এবং উপযুক্ত তাই ব্যবহৃত হয়। যেমন: দাসত্ব করা, অভিমুখী হওয়া, নত হওয়া। এ জন্য আল্লাহর শানে ইশক (চরম পর্যায়ের ভালবাসা), আসক্তি, তীব্র আকাঙ্ক্ষা, মোহ, কামনা-বাসনা…উল্লেখ করা হয় না। তবে (আল্লাহ শানে) কখনো মোহাব্বত (ভালবাসা) শব্দটিও উল্লেখ করা হয়। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন, يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ “তাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে।” (সূরা মায়িদা: ৫৪) [ইমাম ইবনুল কাইয়েম-ইগাসাতুল লাহফান]
❑ ২. মোহাব্বত (ভালবাসা) শব্দের ব্যবহার:
কুরআন-সুন্নায় মোহব্বত (ভালোবাসা) শব্দটি বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর প্রতি, কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি, আবার কখনো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
➧ কয়েকটি উদাহরণ:
◈ মহান আল্লাহ বলেন,
مِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّه
“আর কোন লোক এমনও রয়েছে, যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ইমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশি।” [সূরা বাকারা: ১৬৫]
◈ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ
“হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে তা দিন থেকে ফিরে যাবে, অচিরেই আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে।” [সূরা মায়িদা: ৫৪]
◈ তিনি আরও বলেছেন,
قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْكُمُ اللهُ
“(হে নবি) আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো তাহলে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।” [সূরা আলে ইমরান: ৩১]
◈ প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
“তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা, পুত্র ও অন্য সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হই।” [সহীহ বুখারি]
◈ তিনি আরও বলেন,
ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ
“তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকে, সে ঈমানের স্বাদ পায়। আল্লাহ ও তাঁর রসুল তার কাছে অন্য সব কিছুর থেকে প্রিয় হওয়া, কাউকে কেবল আল্লাহর জন্যই ভালবাসা এবং কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত ঘৃণা করা।” [বুখারি ও মুসলিম]
এভাবে এই মোহাব্বত (ভালবাসা) শব্দটি কুরআন ও হাদিসে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কোথাও ‘ইশক/এশক শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। অথচ শরিয়ী শব্দাবলীর ব্যবহার কুরআন-সুন্নাহর মধ্যেই সীমিত থাকা জরুরি।
উল্লেখ্য যে, মোহাব্বত (ভালবাসা) শব্দটি স্বামী, স্ত্রী, পিতা, মাতা, সন্তান, আলেম, কুরআন, হাদিস ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহারযোগ্য। যদিও পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মোহাব্বত বা ভালবাসার বিভিন্ন প্রকারভেদ হয়ে থাকে। (যেমনটি ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহ. উল্লেখ করেছেন।)
❑ ৩. আল্লাহর ও তাঁর রসুলের শানে ‘প্রেম’ শব্দের ব্যবহার:
কতিপয় আলেম বলেন যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ‘প্রেম’ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। কারণ তা নাকি যৌন চাহিদা বা যৌনাকাঙ্ক্ষা যুক্ত ভালবাসাকে বুঝায়। কিন্তু এ মতটি আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি। কারণ বাংলা অভিধানে এই শব্দটি প্রণয় এবং সাধারণ ভালোবাসা, স্নেহ, ভক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এই ভালবাসায় যৌনাকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। যেভাবে শুধু ‘ভালোবাসা’ শব্দটিও উভয় ধরনের অর্থই প্রকাশ করে। ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে প্রেম শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে: ১ প্রণয়, ভালোবাসা, ২. প্রীতি (বন্ধুত্ব). ৩. স্নেহ [বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান-পরিমার্জিত সংস্করণ]
❑ যৌনাকাঙ্ক্ষা মুক্ত সাধারণ ভালোবাসা, অনুরাগ এবং স্নেহ অর্থে প্রেম শব্দ ব্যবহারের কিছু উদাহরণ:
◆ দেশপ্রেম: স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগ।
◆ দেশপ্রেমী: স্বদেশকে যে ভালোবাসে।
◆ প্রকৃতি প্রেমিক: প্রকৃতিকে ভালোবাসে এমন।
◆ বৃক্ষ প্রেমী: গাছ ভালোবাসে এমন।
◆ ভাতৃপ্রেম/: ভাইয়ের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা।
◆ মাতৃ প্রেম: মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বোধক ভালোবাসা।
◆ আত্ম প্রেম: নিজের প্রতি ভালোবাসা।
◆ ভাষা প্রেমিক: ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ আছে এমন।
◆ গ্রন্থ প্রেমী: বই পড়তে ভালোবাসে এমন।
◆ সাহিত্য প্রেমিক: সাহিত্যকে ভালোবাসে এমন।
◆ ঈশ্বর প্রেম: বিধর্মীরা তাদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা প্রকাশে এই শব্দটি ব্যবহার করে। [বানান আন্দোলন ও অন্যান্য]
একইভাবে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি সম্মানসুলভ অগাধ ভালোবাসা বোঝাতে এ শব্দটি ব্যবহারে কোন দোষ নেই ইনশাআল্লাহ। তবে বলা যায়, বিতর্ক এড়াতে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ক্ষেত্রে এ শব্দটি পরিহার করাই ভালো।
হ্যাঁ, কেউ যদি যৌনাকাঙ্ক্ষা সুলভ ভালোবাসা ও প্রেমাসক্তি অর্থে মহান আল্লাহ ও তাঁর রসুলের শানে এই শব্দটি ব্যবহার করে তাহলে তা অবশ্যই হারাম হবে। আল্লাহু আলম (আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন)।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।