নিম্নে আমরা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জালিমদের ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পক্ষ থেকে যে হুমকি ও করুণ পরিণতির কথা বলা হয়েছে সে ব্যাপারে কতিপয় আয়াত ও হাদিস উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।
❂ ১. আল্লাহ জালিমদের কার্যক্রমের ব্যাপারে অসচেতন নন:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ لَا تَحۡسَبَنَّ اللّٰهَ غَافِلًا عَمَّا یَعۡمَلُ الظّٰلِمُوۡنَ اِنَّمَا یُؤَخِّرُهُمۡ لِیَوۡمٍ تَشۡخَصُ فِیۡهِ الۡاَبۡصَارُ مُهۡطِعِیۡنَ مُقۡنِعِیۡ رُءُوۡسِهِمۡ لَا یَرۡتَدُّ اِلَیۡهِمۡ طَرۡفُهُمۡ وَ اَفۡـِٕدَتُهُمۡ هَوَآءٌ
“তুমি কখনও মনে করো না যে, জালিমরা যা করছে সে বিষয়ে মহান আল্লাহ উদাসীন। আসলে তিনি সেদিন পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন, যেদিন সব চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। ভীত-বিহ্বল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছুটাছুটি করবে, আতঙ্কে তাদের নিজেদের দিকেও ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে (ভয়ানক) উদাস।” [সুরা ইবরাহিম: ৪২ ও ৪৩]
❂ ২. জাহান্নামের আজাব দেখার পর প্রতিটি জালিম সারা পৃথিবীর সব সম্পদ দিয়ে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তির প্রত্যাশা করবে:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَوْ أَنَّ لِكُلِّ نَفْسٍ ظَلَمَتْ مَا فِي الْأَرْضِ لَافْتَدَتْ بِهِ ۗ وَأَسَرُّوا النَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ ۖ وَقُضِيَ بَيْنَهُم بِالْقِسْطِ ۚ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
“জাহান্নামের আজাব দেখার পর প্রত্যেক জালিমের (কাফির-মুশরিকের) কাছে যদি সমগ্র পৃথিবীতে যে পরিমাণ অর্থ-সম্পদ আছে তা থাকতো তাহলে সে নিজের মুক্তির বিনিময়ে সে সবকিছু দিতে চাইতো। আর গোপনে গোপনে অনুতাপ করত। বস্তুত: তাদের জন্য সিদ্ধান্ত হবে ন্যায়সঙ্গত। তাদের উপর অবিচার করা হবে না।” [সূরা ইউনুস: ৫৪]
❂ ৩. জালিমের জন্য আখিরাতে কঠোর শাস্তির হুমকি:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَن يَظْلِم مِّنكُمْ نُذِقْهُ عَذَابًا كَبِيرًا
“তোমাদের মধ্যে যে জুলুম (শিরক) করবে আমি তাকে গুরুতর শাস্তি আস্বাদন করাব।” [সূরা ফুরকান: ১৯]
তিনি আরও বলেন,
وَ سَیَعۡلَمُ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡۤا اَیَّ مُنۡقَلَبٍ یَّنۡقَلِبُوۡنَ
“অচিরেই জালিমরা (মুশরিকরা) জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তন স্থল কোথায় হবে।” [সুরা শুআরা: ২২৭]
তিনি আরও বলেন,
وَعَنَتِ الۡوُجُوۡهُ لِلۡحَیِّ الۡقَیُّوۡمِ ؕ وَ قَدۡ خَابَ مَنۡ حَمَلَ ظُلۡمًا
“ আর (কিয়ামতের দিন) চিরঞ্জীব, চির প্রতিষ্ঠিত মহান সত্তার সামনে সকলেই অবনত হবে। আর সে অবশ্যই ব্যর্থ হবে যে (সে দিন) জুলুম (শিরক) নিয়ে হাজির হবে” [সূরা ত্বা-হা: ১১১]
❂ ৪. জালিমের জন্য জাহান্নামের শাস্তির এক ভয়ানক চিত্র:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا ۚ وَإِن يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ ۚ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا
”‘আমি জালিমদের জন্য (কাফের-মুশরেকদের জন্য) প্রস্তুত করে রেখেছি আগুন, যার বেষ্টনী তাদের পরিবেষ্টন করে রাখবে, তারা পানীয় চাইলে তাদের দেয়া হবে গলিত ধাতুর মতো পানীয়, যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে, এটি কত নিকৃষ্ট পানীয়, জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়।” [সুরা কাহফ: ২৯]
❂ ৫. কিয়ামতের দিন অভিশপ্ত জালিমের কোনও ওজর-আপত্তি শোনা হবে না:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَوْمَ لَا يَنفَعُ الظَّالِمِينَ مَعْذِرَتُهُمْ ۖ وَلَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ
“সে দিন জালেমদের (কাফের-মুশরিকদের) ওজর-আপত্তি কোন উপকারে আসবে না, তাদের জন্যে থাকবে অভিশাপ এবং তাদের জন্যে থাকবে মন্দ গৃহ (জাহান্নাম)।” [সূরা মুমিন/গাফির: ৫২]
❂ ৬. দুনিয়াতে জালিমের ধ্বংসাত্মক পরিণতি:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَكَمْ قَصَمْنَا مِن قَرْيَةٍ كَانَتْ ظَالِمَةً وَأَنشَأْنَا بَعْدَهَا قَوْمًا آخَرِينَ
“আমি কত জনপদের ধ্বংস সাধন করেছি যার অধিবাসীরা ছিল জালিম (কাফের-মুশরিক) এবং তাদের পর সৃষ্টি করেছি অন্য জাতি।” [সূরা আম্বিয়া: ১১]
তিনি আরও বলেন,
وَتِلْكَ الْقُرَىٰ أَهْلَكْنَاهُمْ لَمَّا ظَلَمُوا وَجَعَلْنَا لِمَهْلِكِهِم مَّوْعِدًا
“এসব জনপদও তাদেরকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, যখন তারা জালেম হয়ে গিয়েছিল (অর্থাৎ তারা আল্লাহ ও তার রসুলকে অস্বীকার করেছিলো) এবং আমি তাদের ধ্বংসের জন্যে একটি প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করেছিলাম।” [কাহাফ: ৫৯]
তিনি আরও বলেন,
وَكَذَٰلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَىٰ وَهِيَ ظَالِمَةٌ ۚ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ
“এমনই ছিল তোমার রবের ধরপাকড়, যখন তিনি ধরেছিলেন ওই জালিম বসতিগুলোকে (যারা আল্লাহ ও নবি-রসুলদেরকে অবিশ্বাস করেছিলো)। নিশ্চয়ই তার ধরা অনেক কঠিন যন্ত্রণাময়।” [সুরা হুদ: ১০২]
❂ ৭. দুনিয়ার জালিমের ধ্বংসাত্মক পরিণতির করুণ চিত্র:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَكَأَيِّن مِّن قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ فَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَىٰ عُرُوشِهَا وَبِئْرٍ مُّعَطَّلَةٍ وَقَصْرٍ مَّشِيدٍ
“আমি কত জনপদ ধ্বংস করেছি এমতাবস্থায় যে, তারা ছিল জালিম (কাফের-মুশরেক)। এই সব জনপদ এখন ধ্বংসস্তূপ পরিণত হয়েছে এবং কত কূপ পরিত্যক্ত হয়েছে ও কত সুদৃঢ় প্রাসাদ ধ্বংস হয়েছে।” [সূরা হজ: ৪৫]
❂ ৮. জালিমকে আল্লাহর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
“আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে (জুলুম-নির্যাতনকারীদেরকে) ভালবাসেন না।” [সূরা আলে ইমরান: ৫৭ ও ১৪০]
❂ ৯. জালিমকে আল্লাহর হেদায়েত থেকে বঞ্চিত:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
“আর আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না।” [ বাকারা, ২৫৮, সূরা আলে ইমরান: ৮৬, তওবা: ১৯ ও ১০৯, সফ: ৭, জুমা: ৫]
❂ ১০. জালিম আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশপ্ত:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَن لَّعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ
“আল্লাহর অভিসম্পাত জালেমদের উপর (অর্থাৎ ঐ সকল লোকদের উপর যারা ইমানের উপর কুফরিকে প্রাধান্য দিয়েছে)।” [সূরা আরাফ: ৪৪]
তিনি আরও বলেন,
أَلَا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ
“শুনে রাখ, জালেমদের উপর (কাফের-মুশরিক ও মুনাফিকদের উপর) আল্লাহর অভিসম্পাত রয়েছে।” [সূরা হুদ: ১৮]
❂ ১১. কিয়ামতের দিন জালিমের পক্ষে কোনও সাহায্যকারী দাঁড়াবে না:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ
”জালিমদের (কাফের-মুশরিকদের) জন্য কোনও সাহায্যকারী নেই।” [সুরা আলে ইমরান: ১৯২]
❂ ১২. কিয়ামতের দিন জালিমের পক্ষে কোনও সাহায্যকারী ও শুপারিশকারী থাকবে না:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ
“জালিমদের ( (কাফের-মুশরিকদের) কোনও বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে।” [সুরা মুমিন/গাফের: ১৮]
❂ ১৩. কিয়ামতের দিন জালিমের পক্ষে কোনও অভিভাবক ও সাহায্যকারী এসে দাঁড়াবে না:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالظَّالِمُونَ مَا لَهُمْ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ
“আর জলেমদের (কাফের-মুশরিকদের) কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।” [সূরা শূরা: ৮]
❂ ১৪. জুলুম থেকে মুক্তির জন্য দুআ শিক্ষা:
رَبَّنَا لَا تَجۡعَلۡنَا مَعَ الۡقَوۡمِ الظّٰلِمِيۡنَ
“হে আমাদের রব, আমাদেরকে জালিম সম্প্রদায়ের (পাপিষ্ঠদের) অন্তর্ভুক্ত করবেন না।” [সুরা আরাফ: ৪৭]
জালিমের পরিণতি সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস উপস্থাপন করা হলো:
❂ ১. মানুষের উপর জুলুম-অত্যাচারকারী আখিরাতে রিক্ত ও নিঃস্ব অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত,
أَتَدْرُونَ ما المُفْلِسُ؟ قالوا: المُفْلِسُ فِينا مَن لا دِرْهَمَ له ولا مَتاعَ، فقالَ: إنَّ المُفْلِسَ مِن أُمَّتي يَأْتي يَومَ القِيامَةِ بصَلاةٍ، وصِيامٍ، وزَكاةٍ، ويَأْتي قدْ شَتَمَ هذا، وقَذَفَ هذا، وأَكَلَ مالَ هذا، وسَفَكَ دَمَ هذا، وضَرَبَ هذا، فيُعْطَى هذا مِن حَسَناتِهِ، وهذا مِن حَسَناتِهِ، فإنْ فَنِيَتْ حَسَناتُهُ قَبْلَ أنْ يُقْضَى ما عليه أُخِذَ مِن خَطاياهُمْ فَطُرِحَتْ عليه، ثُمَّ طُرِحَ في النَّارِ
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি জান নি:স্ব কে?”
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, “আমাদের মধ্যে নি:স্ব তো সে যার কোন দিনার-দিরহাম (টাকা-পয়সা) বা আসবাব-সামগ্রী নেই।”
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমার উম্মতের মধ্যে সত্যিকার নি:স্ব হল সেই ব্যক্তি যে, কেয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম ও জাকাতসহ অনেক ভালো কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে অথচ দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো প্রতি অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, কারো রক্তপাত ঘটিয়েছিল, কাউকে মেরেছিল। ফলে তার থেকে নেক আমলগুলো নিয়ে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাওনা আদায় করা হবে।
এভাবে যখন তার নেক আমলগুলো শেষ হয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়ার জন্য আর কিছু থাকবে না তখন তাদের পাপগুলো তাকে দেওয়া হবে। ফলে সে (নিঃস্ব অবস্থায়) জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪৭/ সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ১৫. জুলুম করা হারাম]
❂ ২. মানুষের উপর জুলুম-অবিচার করা হলে তা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না মজলুম ব্যক্তির সাথে মিটমাট করে নেওয়া হয়:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“ رَحِمَ اللَّهُ عَبْدًا كَانَتْ لأَخِيهِ عِنْدَهُ مَظْلَمَةٌ فِي عِرْضٍ أَوْ مَالٍ فَجَاءَهُ فَاسْتَحَلَّهُ قَبْلَ أَنْ يُؤْخَذَ وَلَيْسَ ثَمَّ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ فَإِنْ كَانَتْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ حَسَنَاتِهِ وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ حَمَّلُوا عَلَيْهِ مِنْ سَيِّئَاتِهِمْ
“আল্লাহ রহম করুন বান্দার উপর, যার জিম্মায় তার কোন ভাইয়ের সম্মান ও সম্পদ বিনষ্ট করার মত জুলুমের অপরাধ রয়ে গেছে সে যেন এই অপরাধগুলো পাকড়াও হওয়ার আগেই মাফ করিয়ে নেয়। সেখানে (কিয়ামতের ময়দানে) কোন দিনার-দিরহাম (রৌপ্য ও রৌপ্য মুদ্রা) থাকবে না। যদি তার নেক আমল থাকে (মজলুমের বদলায়) তবে নেক আমল নিয়ে যাওয়া হবে। আর তার যদি নেক আমল না থাকে তবে মজলুমদের বদ আমল এনে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। [সহিহ বুখারি সুনানে তিরমিজি, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪০/ কিয়ামত, পরিচ্ছেদ: হিসাব এবং অন্যায়ের বদলা।]
এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিস:
আনাস ইবনে মালেক রা. নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন,
“الظُّلْمُ ثَلاثَةٌ، فَظُلْمٌ لا يَغْفِرُهُ الله، وَظُلْمٌ يَغْفِرُهُ، وَظُلْمٌ لا يَتْرُكُهُ، فَأَمَّا الظُّلْمُ الَّذِي لا يَغْفِرُهُ الله فَالشِّرْكُ قَالَ الله: {إنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ} وَأَمَّا الظُّلْمُ الَّذِي يَغْفِرُهُ ظُلْمُ العِباَدِ أَنْفُسَهُمْ فِيمَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ رَبِّهِمْ وَأَمَّا الظُّلْمُ الَّذِي لا يَتْرُكُهُ الله فَظُلْمُ الْعِبَادِ بَعْضِهِمْ بَعْضًا حَتَّى يُدَبِّرُ لِبَعْضِهِمْ مِنْ بَعْضٍ
জুলুম তিন প্রকার। যথা:
– এমন জুলুম যা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।
– এমন জুলুম যা তিনি ক্ষমা করবেন।
– এমন জুলুম যা আল্লাহ ছাড় দিবেন না।
যে জুলুম আল্লাহ ক্ষমা করবেন না তা হলো, শিরকের জুলুম। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শিরক কারীকে ক্ষমা করবেন না।” [সুরা নিসা: ৪৮]
আল্লাহ এবং বান্দার মাঝের জুলুমকে তিনি ক্ষমা করবেন। তবে কিন্তু সে জুলুমকে আল্লাহ ছাড় দিবেন না যেটা এক বান্দা অন্য বান্দার উপর করে যতক্ষণ না একে অপরের নিকট থেকে বিষয়টি মিটমাট করে না নেয়।”
[মাজমাউয-যাওয়ায়েদ, তায়ালুসি, বাযযার, সিলসিলা সহিহা, হা/১৯২৭-হাসান। তবে অনেক মুহাদ্দিসের মতে হাদিসটি জইফ। জইফ ধরা হলেও তার অর্থটা সঠিক কুরআনের আয়াত ও অন্যান্য বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে]
❂ ৩. জুলুম-অত্যাচার কিয়ামতের দিন ভয়ানক অন্ধকার হিসেবে উপস্থিত হবে:
জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
اتَّقُوا الظُّلمَ ؛ فإنَّ الظُّلمَ ظُلُماتٌ يومَ القيامةِ
“তোমরা জুলুম-নির্যাতন করার ব্যাপারে সতর্ক হও। কারণ জুলুম-নির্যাতন পরকালে অন্ধকার (হিসেবে উপস্থিত হবে)।” [বুখারি ও মুসলিম] অর্থাৎ কিয়ামত দিবসে যে দিন মুমিনদের সামনে-পেছনে ডানে-বামে আলোকিত থাকবে (দেখুন: সূরা হাদিদ: ১২)। সে সময় অত্যাচারীর চারদিকে থাকবে অন্ধকার। ফলে সে মুক্তির পথ খুঁজে পাবে না।
❂ ৪. মজলুমের বদদুআ আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“ ثَلاَثُ دَعَوَاتٍ يُسْتَجَابُ لَهُنَّ لاَ شَكَّ فِيهِنَّ دَعْوَةُ الْمَظْلُومِ وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ وَدَعْوَةُ الْوَالِدِ لِوَلَدِهِ
“তিন ব্যক্তির দুআ কবুল হয়। এতে কোন সন্দেহ নাই। মজলুম (নির্যাতিত) এর দুআ, মুসাফিরের দুআ ও সন্তানের জন্য পিতার দুআ।” [সুনানে তিরমিজি, ১৯০৫, ৩৪৪৮, ১৫৩৬, মুসনাদে আহমদ ৭৪৫৮, ৮৩৭৫, ৯৮৪০, ১০৩৩০, ১০৩৯২। সিলসিলা সহীহাহ ৫৯৬, সহীহ আবু দাউদ ১৩৭৪]
❂ ৫. জুলুম-নির্যাতন করা কোনও মুসলিমের বৈশিষ্ট্য নয়:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ
“এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সুতরাং সে তার প্রতি জুলুম করবে না, তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবে না এবং তাকে তুচ্ছ ভাববে না।” [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৬৪]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ
“এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), অধ্যায়: ৪৬/ অত্যাচার, কিসাস ও লুণ্ঠন, পরিচ্ছেদ: ৪৬/৩. মুসলিম মুসলিমের প্রতি অত্যাচার করবে না এবং তাকে অপমানিতও করবে না]
❂ ৬. জুলুম-নির্যাতন করা হারাম:
ইমাম মুসলিম আবু যার রা. হতে বর্ণনা করেন যে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা (হাদিসে কুদসিতে) বলেন,
يا عبادي إنِّي حرَّمتُ الظُّلمَ على نفسي وجعلتُهُ بينَكم محرَّمًا
“হে আমার বান্দাগণ, আমি জুলুমকে নিজের উপর হারাম করেছি এবং তোমাদের উপরও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর জুলুম করবে না।” [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫২]
❂ ৭. আল্লাহ অত্যাচারীকে ছাড় দেন কিন্তু ধরলে ছাড়েন না:
আবু মুসা আশআরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“ إِنَّ اللَّهَ لَيُمْلِي لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ ”. قَالَ ثُمَّ قَرَأَ (وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهْىَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ)
“আল্লাহ তাআলা জালিমদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন তাকে পাকড়াও করেন, তখন আর ছাড়েন না। (বর্ণনাকারী বলেন) এরপর তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ আয়াত পাঠ করেন।” এবং এরূপই তোমার রবের শাস্তি।” তিনি শাস্তি দান করেন জনপদসমূকে যখন তারা জুলুম করে থাকে। তার শাস্তি মর্মন্তুদ, কঠিন। (১১: ১০২)
[সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫২/ তাফসির, পরিচ্ছেদ: ২৪১৬. আল্লাহ তাআলার বাণী: “এবং এরূপই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি। তিনি শাস্তি দান করেন জনপদসমূহকে, যখন তারা জুলুম করে থাকে। তার শাস্তি মর্মন্তুদ কঠিন।” (১১: ১০২)]
❂ ৮. কারও উপর জুলুম করা বা জুলুমের শিকার না হওয়ার জন্য আল্লাহর নবির দুআ:
«اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ وَالْقِلَّةِ وَالذِّلَّةِ وَأَعُوذُ مِنْ أَنْ أَظْلِمَ أَوْ أُظْلَمَ»
উচ্চারণ: “আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল ফাক্বরি, ওয়াল ক্বিল্লাতি ওয়ায্ যিল্লাতি ওয়া আঊযুবিকা মিন্ আন্ আযলিমা আও উযলামা’’
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অস্বচ্ছলতা, স্বল্পতা, অপমান-অপদস্থ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করি এবং আমি অত্যাচারী অথবা অত্যাচারিত হওয়া হতেও তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।
❂ ৯. অত্যাচারকারীকে ক্ষমা করা অথবা অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ করা অথবা বিচারের ভার আল্লাহর উপর সমর্পণ করা-কোনটি উত্তম?
কেউ কারো প্রতি জুলুম/অত্যাচার করলে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে যথাসম্ভব ধৈর্য ধারণ করা উত্তম। তবে ইচ্ছে করলে জুলুমের প্রতিশোধ নেয়া জায়েজ আছে। তবে তা যেন যতটুকু জুলুম করা হয়েছে ততটুকুই হয়; এর চেয়ে অতিরিক্ত না হয়।
এ বিষয়ে নিম্নোক্ত হাদীস দুটি দেখুন:
◆ ১. সম্মানিত সাহাবি আবু বকর রা. এর ঘটনা:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। এক লোক এসে আবু বকর রা.-কে বকাবকি করতে লাগল। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানেই বসে ছিলেন। তিনি এ কাণ্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। লোকটি বেশি মাত্রায় বকাবকি শুরু করলে আবু বকর রা. তার দু-একটি কথার জবাব দিলেন। এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগ করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন।
আবু বকর রা. পেছনে পেছনে গিয়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন: হে আল্লাহর রসুল, লোকটি আমাকে বকাবকি করছিল আর আপনি সেখানে বসে ছিলেন। কিন্তু যখনই তার কিছু কথার জবাব দিলাম তখনই আপনি রেগে সেখান থেকে চলে আসলেন।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: তোমার সাথে একজন ফেরেশতা ছিল যে তোমার পক্ষ থেকে উত্তর দিচ্ছিল। আর যখনই তুমি উত্তর দিলে সেখানে শয়তান ঢুকে পড়ল।
আর হে আবু বকর, তিনটি জিনিস খুবই সত্য:
ক. কেউ কোন ব্যাপারে জুলুমের শিকার হওয়ার পর সে যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে তা ক্ষমা করে দেয় তবে এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাকে সম্মান জনক ভাবে সাহায্য করেন।
খ. কেউ যদি (কোন আত্মীয়ের সাথে বা সাধারণ মুসলমানের সাথে) সুসম্পর্ক তৈরির উদ্দেশ্যে দানের রাস্তা খুলে তবে আল্লাহর তার সম্পদ আরও বৃদ্ধি করে দেন।
গ. আর কেউ যদি সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষের কাছে ভিক্ষার দরজা উন্মুক্ত করে তবে আল্লাহ তাআলা তার সম্পদ কমিয়ে দেন।” [মুসনাদ আহমদ, আলবানী বলেন, হাদীসটি হাসান। মিশকাত হাদিস নং ৫১০২]
◆ ২. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “দু জন লোক যদি পরস্পরকে গালাগালি করে তবে যাবতীয় গুনাহ তার উপর বর্তাবে যে আগে শুরু করেছে যদি অত্যাচারিত ব্যক্তি প্রতি উত্তরে অতিরিক্ত না বলে।” [সহীহ মুসলিম]
এ হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি আগে কাউকে কষ্ট দেয় বা গালি দেয় তবে তার সমপরিমাণ প্রতি উত্তরে দেওয়া জায়েজ আছে আর তার যাবতীয় গুনাহ যে আগে শুরু করেছে তার উপর বর্তাবে। কারণ সেই এর মূল কারণ। অবশ্য যদি প্রতি উত্তরে সে অতিরিক্ত গালমন্দ করে তবে যে পরিমাণ অতিরিক্ত গালমন্দ করেছে তার জন্য গুনাহগার হবে। কারণ,ইসলামে কেবল সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেয়ার অনুমোদন রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا ۖ فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّـهِ ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
“অন্যায়ের প্রাপ্য শুধু সমপরিমাণ অন্যায়। তবে যে ব্যক্তি ক্ষমা করে দেয় এবং সমঝোতা করে সে আল্লাহর নিকট পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। তিনি তো অত্যাচারীদেরকে পছন্দ করেন না। [সূরা শূরা: ৪০]
যদিও সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেয়া জায়েজ আছে তবুও ধৈর্য ধারণ করা উত্তম। যেমনটি আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত পূর্বোক্ত হাদিসটিতে বর্ণিত হয়েছে।
তবে কেউ যদি জুলুমকারীকে ক্ষমাও না করে এবং প্রতিশোধ গ্রহণ না করে বরং আখিরাতে আল্লাহর নিকট বিচারের ভার সপে দেয় তাহলে তা জায়েজ রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ আখিরাতে এর যথোপযুক্ত ন্যায় সঙ্গত বিচার করবেন। সে দিন মহান বিচারক আল্লাহ তাআলা জালিমের সওয়াবগুলো মজলুমকে দিবেন এবং মজলুমের গুনাহগুলো জালিমের উপর চাপিয়ে দিবেন। এভাবে অত্যাচারকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তি লাভবান হবে। ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য যে, কেউ কারো উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর নিকট তওবার মাধ্যমে তা ক্ষমা হবে না যতক্ষণ অত্যাচারিত ব্যক্তি তাকে ক্ষমা না করে বা দুজনের মাঝে দুনিয়াতে সমঝোতা না হয়।
আল্লাহ আমাদেরকে জলুম করা থেকে এবং জুলুমের শিকার হওয়া হতে হেফাজত করুন। আমিন। (সমাপ্ত)
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার। সৌদি আরব।