শবে মিরাজ পালন করা বিদআত

মিরাজ দিবস কিংবা শবে মিরাজ উদযাপন করা রজব মাসের অন্যতম বিদআত। জাহেলরা এই বিদআতকে ইসলামের উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রতি বছর তা পালন করে যাচ্ছে! এরা রজব মাসের সাতাইশ তারিখকে শবে মিরাজ পালনের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে। এ উপলক্ষে এরা একটি নয় একাধিক বিদআত তৈরি করেছে। যেমন:
— শবে মিরাজ উপলক্ষে মসজিদে মসজিদে একত্রিত হওয়া।
— মসজিদে কিংবা মসজিদের মিনারে মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো বা আলোকসজ্জা করা।
— এ উপলক্ষে অর্থ খরচ করা।
— কুরআন তিলাওয়াত বা জিকিরের জন্য একত্রিত হওয়া।
— ‘মিরাজ দিবস’ উপলক্ষে মসজিদে বা বাইরে সভা-সেমিনার আয়োজন করে তাতে মিরাজের ঘটনা বয়ান করা ইত্যাদি। এগুলো সবই গোমরাহি এবং বাতিল কর্মকাণ্ড। এ প্রসঙ্গে কুরআন-সুন্নাহতে ন্যূনতম কিছু বর্ণিত হয়নি। তবে এভাবে দিবস পালন না করে যে কোন সময় মিরাজের ঘটনা বা শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা দোষণীয় নয়।

❑ ক. কোন রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা ও মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল?

যে রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা ও মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল সেটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্ব যুগ থেকেই ওলামাগণের মাঝে মত পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন হাদীস না থাকায় আলেমগণ বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন।

◈ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন, মিরাজের সময় নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
কেউ বলেছেন, নবুওয়তের আগে। কিন্তু এটা একটি অপ্রচলিত মত। তবে যদি উদ্দেশ্য হয়, যে সেটা স্বপ্ন মারফত হয়েছিল সেটা ভিন্ন কথা।

◈ অধিকাংশ আলেমগণের মত হল, তা হয়েছিল নবুওয়তের পরে। তবে নবুওয়তের পরে কখন সেটা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।

◈ কেউ বলেছেন, হিজরতের এক বছর আগে। ইবনে সা’দ প্রমুখ এ মতের পক্ষে। ইমাম নওয়াবি রহ. এই মতটির পক্ষে জোর দিয়ে বলেছেন। তবে ইবনে হাজাম এর পক্ষে আরও শক্ত অবস্থান নিয়ে বলেন, “এটাই সর্ব সম্মত মত।” এই মতের আলোকে বলতে হয় মিরাজ হয়েছিল রবিউল আওয়াল মাসে।

কিন্তু তার কথা অগ্রহণ যোগ্য। কারণ, এটা সর্ব সম্মত মত নয়। বরং এক্ষেত্রে প্রচুর মতবিরোধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশটির অধিক মত পাওয়া যায়।

◈ ইবনুল জাওজি বলেন, হিজরতের আট মাস আগে মিরাজ হয়েছিল। এ মতানুসারে সেটা ছিল রজব মাসে।

◈ কেউ বলেন, হিজরতের ছয় মাস আগে। এ মত অনুযায়ী সেটা ছিল রমাযানে। এ পক্ষে মত দেন আবুর রাবী বিন সালেম।

◈ আরেকটি মত হল, হিজরতের এগার মাস আগে। এ পক্ষে দৃঢ়তার সাথে মত ব্যক্ত করেন, ইবরাহীম আল হারবি। তিনি বলেন, হিজরতের এক বছর আগে রবিউস সানিতে মিরাজ সংঘটিত হয়।

◈ কারো মতে, হিজরতের এক বছর তিন মাস আগে। ইবনে ফারিস এ মত পোষণ করেন।

এভাবে আরও অনেক মতামত পাওয়া যায়। কোন কোন মতে রবিউল আওয়াল মাসে, কোন মতে শাওয়াল মাসে, কোন মতে রমজান মাসে, কোন মতে রজব মাসে।

◈ আর তাই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, “ইবনে রজব বলেন, রজব মাসে বড় বড় ঘটনা ঘটেছে মর্মে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু কোনটির পক্ষেই সহীহ দলীল নাই। বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রজবের প্রথম রাতে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন, সাতাইশ বা পঁচিশ তারিখে নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন অথচ এ সব ব্যাপারে কোন সহীহ দলিল পাওয়া যায় না।” [লাতাইফুল মায়ারেফ, ১৬৮ পৃষ্ঠা]

◈ আবু শামাহ বলেন, গল্পকারেরা বলে থাকে যে, ইসরা ও মিরাজের ঘটনা ঘটেছিল রজব মাসে। কিন্তু ‘ইলমুল জারহে ওয়াত তাদিল’ (علم الجرح والتعديل বা বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের শাস্ত্র) বিশেষজ্ঞ আলেমগণের মতে এটা ডাহা মিথ্যা। [আল বায়িস: ১৭১]

❑ খ. শবে মিরাজ পালন করার বিধান:

সালফে সালেহিনগণ এ মর্মে একমত যে, ইসলামি শরিয়তে অনুমোদিত দিন ছাড়া অন্য কোন দিবস উদযাপন করা বা আনন্দ-উৎসব পালন করা বিদআত। কারণ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

“مَنْ أَحْدَثَ فِي دِينِنَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ”

“যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করে, যা এর অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” [বুখারি, অধ্যায়: সন্ধি-চুক্তি।]

আর সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে:

“مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ”

“যে এমন কোনো কাজ করে যা আমাদের আদেশের সাথে সঙ্গত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।”
[মুসলিম, অধ্যায়: বিচার-ফয়সালা]

সুতরাং মিরাজ দিবস অথবা শবে মিরাজ পালন করা দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট বিদআতের অন্তর্ভুক্ত সাহাবিগণ, তাবেঈনগণ বা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী সালফে সালেহীনগণ তা পালন করেন নি। অথচ সকল ভাল কাজে তারা ছিলেন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী।

◈ ইবনুল কাইয়েম জাওযিয়া রহ. বলেন, “ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, পূর্ববর্তী যুগে এমন কোন মুসলমান পাওয়া যাবে না যে শবে মিরাজকে অন্য কোন রাতের উপর মর্যাদা দিয়েছে। বিশেষ করে শবে কদরের চেয়ে উত্তম মনে করেছে এমন কেউ ছিল না। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের একনিষ্ঠ অনুগামী তাবেয়িনগণ এ রাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন কিছু করতেন না।এমনকি তা আলাদাভাবে স্মরণও করতেন না। যার কারণে জানাও যায় না যে, সে রাতটি কোনটি।

নি:সন্দেহে ইসরা ও মিরাজ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এজন্য এর মিরাজের স্থানকালকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত করা বৈধ নয়। এমনকি যে হেরা পর্বতে ওহি নাজিলের সূচনা হয়েছিল এবং নবুওয়তের আগে সেখানে তিনি নিয়মিত যেতেন নবুওয়ত লাভের পর মক্কায় অবস্থান কালে তিনি কিংবা তাঁর কোন সাহাবি সেখানে কোন দিন যাননি। তারা ওহি নাজিলের দিনকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত-বন্দেগি করেন নি বা সেই স্থান বা দিন উপলক্ষে বিশেষ কিছুই করেননি।

যারা এ জাতীয় দিন বা সময়ে বিশেষ কিছু ইবাদত করতে চায় তারা ঐ আহলে কিতাবদের মত যারা ঈসা আলাইহিস সালাম এর জন্ম দিবস (Chisthomas) বা তাদের দীক্ষাদান অনুষ্ঠান (Baptism) পালন ইত্যাদি পালন করে।

উমর ইবনুল খাত্তাব রা. দেখলেন, কিছু লোক একটা জায়গায় নামাজ পড়ার জন্য হুড়াহুড়ি করছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী?

তারা বলল, এখানে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ পড়েছিলেন।

তিনি বললেন, তোমরা কি তোমাদের নবীদের স্মৃতি স্থলগুলোকে সাজদার স্থান বানাতে চাও? তোমাদের পূর্ববর্তী জমানার লোকেরা এ সব করতে গিয়েই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানে এসে যদি তোমাদের কারো নামাজের সময় হয় তবে সে যেন নামাজ পড়ে অন্যথায় সামনে অগ্রসর হয়।” [মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ২য় খণ্ড, ৩৭৬, ৩৭৭]

◈ ইবনুল হাজ্জ বলেন,“রজব মাসে যে সকল বিদআত আবিষ্কৃত হয়েছে সবগুলোর মধ্যে সাতাইশ তারিখের লাইলাতুল মিরাজের রাত অন্যতম।”[আল মাদখাল, ১ম খণ্ড, ২৯৪পৃষ্ঠা]

পরিশেষে বলব, যেহেতু রজব মাসে নফল নামাজ, রোজা করা, মসজিদ, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট দোকান-পাট ইত্যাদি সাজানো, সেগুলোকে আলোক সজ্জা করা কিংবা ছাব্বিশ তারিখের দিবাগত রাত তথা সাতাইশে রজবকে শবে মিরাজ নির্ধারণ করে তাতে রাত জেগে ইবাদত করার ব্যাপারে কোন গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নাই। তাই আমাদের কর্তব্য হবে সেগুলো থেকে দূরে থাকা। অন্যথায় আমরা বিদআত করার অপরাধে আল্লাহ তাআলার দরবারে গুনাহগার হিসেবে বিবেচিত হব। অবশ্য কোন ব্যক্তি যদি প্রতি মাসে কিছু নফল রোজা রাখে সে এমাসেও সেই ধারাবাহিকতা অনুযায়ী এ মাসে রোজা রাখতে পারে, শেষ রাতে উঠে যদি নফল নামাজের অভ্যাস থাকে তবে তবে এ মাসের রাতগুলিতেও নামাজ পড়তে পারে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল অবস্থায় তাওহিদ ও সুন্নাহর উপর আমল করার তাওফিক দান করুন এবং শিরক ও বিদআত থেকে হেফাজত করুন। আমিন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উৎস: আল বিদা’ আল হাওলিয়াহ
লেখক: শাইখ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ আত তুওয়াইজিরি।
অনুবাদ ও সংক্ষেপায়ন: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডন্সে সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: