রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন-সংক্রান্ত প্রচলিত গল্পটি বানোয়াট ও হাদিসের নামে মিথ্যাচার

প্রশ্ন: নিম্নোক্ত ঘটনাটি কি সহিহ? নবীজীর কাছে তাঁর সকল বিবি বসা ছিলেন। এমন সময়, এক বিবি প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি আপনার বিবিদের মাঝে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন? কেমন কঠিন প্রশ্ন! কারণ সকল বিবি এখানে উপস্থিত। নবীজী কাকে হাসাবেন আর কাকে কাঁদাবেন? তাই কৌশলে বললেন, আগামী কালকে তার জবাব দেব ইনশাআল্লাহ।

অতপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কুমারী স্ত্রী আয়েশা রা. এর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁকে ২টি খেজুর দিয়ে বললেন, আয়েশা, এই খেজুরের কথা কাউকে বলবে না।

এভাবে সকল বিবির ঘরে প্রবেশ করে সকলকেই ২টি করে খেজুর দিয়ে বললেন, এই খেজুরের কথা কাউকে বলবে না। অতপর পরের দিন সকল বিবি একত্রিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহ রাসুল, জবাব দিন, আপনি কোন স্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন?

নবীজী উত্তরে বলেন, গত রাতে যাকে আমি ২টি খেজুর দিয়ে ছিলাম। তাকেই সবচাইতে বেশি ভালবাসি। তখন সকল বিবি মনে মনে আনন্দিত হয়ে গেলেন।

নবিজী মুচকি হাসলেন। কারণ নবিজী তো সকলকেই খেজুর দিয়ে ছিলেন। কিন্তু একজনের টা অন্যজন জানে না।

অতএব নবীজীর ভালবাসা সকলের উপর সমান ভাবে চলে গেল। কেউ নারাজ হয়নি। এটাকেই বলে ইনসাফ ও ইসলামি বিনোদন এবং সুন্দর কৌশল! এটার নামই দীন-ইসলাম। কত যে শান্তি ইসলামে আমরা তা বুঝি না। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর:
এটি কোনও হাদিস নয় বরং হাদিসের নামে মিথ্যাচার। এ বিষয়টি islamweb, dorar ইত্যাদি বিশ্ববিখ্যাত ওয়েব সাইটগুলো এবং বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ স্পষ্ট করেছেন-আল হামদুলিল্লাহ।

এর কয়েকটি কারণ। যথা:

◈ ১. সোশ্যাল মিডিয়া এবং কিছু মূর্খ গল্পবাজ বক্তা ছাড়া কোনও হাদিস গ্রন্থে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।

◈ ২. তাছাড়া এই মুখরোচক গল্পে ভাষা শৈলির দুর্বলতা স্পষ্ট-যা হাদিসে নব্বীর ভাষার সাথে বেমানান।
◈ ৩. শুধু তাই নয়, সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহর রাসুল এবং এমন অতুলনীয় মহাজ্ঞানী মহামানবের পক্ষ থেকে তাঁর স্ত্রীদের সাথে এমন দুর্বল কৌশল অকল্পনীয়। কারণ একাধিক স্ত্রীর মাঝে এ জাতীয় গোপনীয়তা ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। জীবনের কোনও না কোনও সময় তা প্রকাশিত হবে বলেই ধারণা করা যায়। তখন তিনি তাদের সামনে মিথ্যাবাদী ও অবিশ্বস্ত (নাউযুবিল্লাহ) বলে প্রতীয়মান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং তা যে বানোয়াট গল্প তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

◈ ৪. আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সকল স্ত্রীর মধ্যে মা জননী আয়েশা রা. কে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন তা স্পষ্ট করেই বলেছেন। যেমন:
عَمْرُو بْنُ الْعَاصِ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم بَعَثَهُ عَلَى جَيْشِ ذَاتِ السَّلاَسِلِ، فَأَتَيْتُهُ فَقُلْتُ أَىُّ النَّاسِ أَحَبُّ إِلَيْكَ قَالَ ‏”‏ عَائِشَةُ ‏”‏‏.‏ فَقُلْتُ مِنَ الرِّجَالِ فَقَالَ ‏”‏ أَبُوهَا ‏”‏‏.‏ قُلْتُ ثُمَّ مَنْ قَالَ ‏”‏ ثُمَّ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ ‏”‏‏.‏ فَعَدَّ رِجَالاً‏.‏

আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে যাতুস সালাসিল যুদ্ধের সেনানায়ক করে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষের মধ্যে কে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয়?
তিনি বললেন, আয়েশা।
আমি বললাম, পুরুষদের মধ্যে কে?
তিনি বললেন, আয়েশার পিতা (আবু বকর রা.)।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর কে?
তিনি বললেন, উমর ইবনুল খাত্তাব। তারপর আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেন। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

৫. তাছাড়া আয়েশা রা. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রা. কে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন-এ বিষয়টি সাহাবিদের নিকটও সুবিদিত ছিল। তাই তো তিনি যেদিন আয়েশা.-এর ঘরে থাকতেন সেদিন সাহাবিগণ সে দিন তাঁর নিকট উপহার-সামগ্রী পাঠাতেন। হাদিসে এসেছে,
وَكَانَ الْمُسْلِمُوْنَ قَدْ عَلِمُوْا حُبَّ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَائِشَةَ فَإِذَا كَانَتْ عِنْدَ أَحَدِهِمْ هَدِيَّةٌ يُرِيْدُ أَنْ يُهْدِيَهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَخَّرَهَا حَتَّى إِذَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيْ بَيْتِ عَائِشَةَ بَعَثَ صَاحِبُ الْهَدِيَّةِ بِهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيْ بَيْتِ عَائِشَةَ

উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালামা রা. সাহাবিদের এই উপহার পাঠানোর বিষয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট কথা তুললে তিনি কয়েকবার চুপ থাকার পর অবশেষে বললেন,
لَا تُؤْذِيْنِيْ فِيْ عَائِشَةَ فَإِنَّ الْوَحْيَ لَمْ يَأْتِنِيْ وَأَنَا فِيْ ثَوْبِ امْرَأَةٍ إِلَّا عَائِشَةَ

“আয়েশা রা.-এর ব্যাপার নিয়ে আমাকে কষ্ট দিও না। মনে রেখ, আয়েশারা. ব্যতীত আর কোন স্ত্রীর বস্ত্র তুলে থাকা অবস্থায় আমার উপর ওহি নাজিল হয়নি।”

(আয়েশা রা.) বলেন, এ কথা শুনে তিনি (উম্মে সালামা রা.) বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, “আপনাকে কষ্ট দেয়া হতে আমি আল্লাহর নিকট তওবা করছি।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), ৫১/ হেবা ও এর ফজিলত, পরিচ্ছেদ: ৫১/৮. সঙ্গীকে কোন হাদিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তার অন্য স্ত্রী ছেড়ে কোন স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত দিনের অপেক্ষা করা।]

এসব হাদিস থেকেও প্রমাণিত হয়, আল্লাহর রাসূলের কাছে তাঁর কোনও স্ত্রী সবচেয়ে বেশি ভালবাসার পাত্র তা তাঁদের সকলের জানা ছিল। সুতরাং তাঁদের একসাথে জোট বেঁধে তাঁকে এমন প্রশ্ন করে বিব্রত করার আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল না।
অতএব, এটি গল্পবাজ বক্তা ও দীন বিষয়ে মূর্খ লোকদের তৈরি করা হাদিস তা স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়।

সুতরাং মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্য ছাড়া এ জাতীয় হাদিস প্রচার করা ও বর্ণনা করা হারাম।

● রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বানোয়াট হাদিস বর্ণনার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেন,
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার উপর মিথ্যা রোপ করল (মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করল), সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা করে নিলো।” (সহিহ বুখারি, অনুচ্ছেদ: আম্বিয়াদের হাদিস, হাদিস নং ৩২৭৪)

● তিনি আরও বলেন,
كفى بالمرء كذباً أن يحدث بكل ما سمع
“মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।” (সহিহ মুসলিম এর ভূমিকা, আবু দাউদ ৪/২৯৮, ইবনে হিব্বান, ১/২১৩ )

● অন্য বর্ণনায় এসেছে
كفى بالمرء إثما أن يحدث بكل ما سمع
“গুনাহ হওয়ার জন্য এতটুকুই এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।” (সিলসিলা সহিহা হা/২০২৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বানোয়াট হাদিস, ও দলিল বহির্ভূত কিচ্ছা-কাহিনী থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: