ইসলামের দৃষ্টিতে গোয়েন্দাগিরি করা এবং গোয়েন্দা বিভাগে চাকুরী করার বিধান

প্রশ্ন: এক আলোচনায় শুনলাম যে, ইসলামে গোয়েন্দাগিরি নিষিদ্ধ। আমার প্রশ্ন হল, তবে কি গোয়েন্দা বিভাগে চাকুরী করা হারাম?
উত্তর:
মানুষের ব্যক্তিগত পাপাচার ও দোষত্রুটি অনুসন্ধান করা, কারও ক্ষতি করা, নিজের ব্যক্তিগত অবৈধ স্বার্থ হাসিল ইত্যাদি উদ্দেশ্যে কারও জন্য পিছে লেগে থাকা ও গোয়েন্দাগিরি করা ইসলামে নিষিদ্ধ।

◈ এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ۖ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা পাপ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত: তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুল কারী, পরম দয়ালু।” (সূরা হুজুরাত: ১২)

তাফসিরে ত্ববারিতে এ আয়াতে মহান আল্লাহর বাণী: وَلَا تَجَسَّسُوا “এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না” এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,

ولا يتتبع بعضكم عورة بعض, ولا يبحث عن سرائره, يبتغي بذلك الظهور على عيوبه ، ولكن اقنعوا بما ظهر لكم من أمره ، وبه فحمدوا أو ذموا ، لا على ما لا تعلمونه من سرائره

“তোমাদের কেউ যেন কারও দোষত্রুটি জানার উদ্দেশ্য তার গোপনীয় বিষয়ের পেছনে লেগে না থাকে এবং তার লুকায়িত বিষয়গুলো অনুসন্ধান না করে। বরং তোমরা তার বাহ্যিক বিষয়ে তুষ্ট থাকবে। বাহ্যিক অবস্থার উপর ভিত্তি করেই মানুষ প্রশংসা অথবা নিন্দার পাত্র হবে; তোমরা তাদের গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে যা জান তার উপর ভিত্তি করে নয়।”

◈ আবু বারযাহ আসলামী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلِ الإِيمَانُ قَلْبَهُ لاَ تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ وَلاَ تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِى بَيْتِهِ

“হে সেই মানুষের দল; যারা মুখে ঈমান এনেছে এবং যাদের হৃদয়ে ঈমান স্থান পায়নি (তারা শোন)! তোমরা মুসলিমদের গীবত (পরচর্চা বা কারও অসাক্ষাতে তার দোষত্রুটি সমালোচনা) করো না এবং তাদের দোষ খুঁজে বেড়ায়ো না। কারণ, যে ব্যক্তি তাদের দোষ খুঁজবে, আল্লাহ তার দোষ ধরবেন। আর আল্লাহ যার দোষ ধরবেন তাকে তার ঘরের ভিতরেও লাঞ্ছিত করবেন।” [আহমাদ ৪/৪২০, আবু দাউদ, হা/৪৮৮০, আবু ইয়ালা, সহীহুল জামে, হা/ ৭৯৮৪-সহিহ]

এ ক্ষেত্রে করণীয় হল, মানুষের ব্যক্তিগত পাপাচার ও ত্রুটি-বিচ্যুতি কারও সামনে প্রকাশ না করা বরং তা গোপন রাখা। গোয়েন্দাগিরি ছাড়াই যদি জানা হয়ে যায় তাহলে তাকে নসিহত করা ও সংশোধন করার চেষ্টা করা জরুরি।

◈ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

“যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ গোপন রাখে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।” [সুনান তিরমিজী (ই.ফা.) ১৭/ দণ্ডবিধি, পরিচ্ছেদ: মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখা প্রসঙ্গে।-সহিহ]

সুতরা এ হীন উদ্দেশ্যে গোপনে কারও কথা শোনার চেষ্টা করা, ঘরের ছিদ্র বা জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরে উঁকি দেয়া, ফেসবুকের আইডি হ্যাক করা, পাসওয়ার্ড চুরি করা, তার অজান্তে তার ইনবক্স চেক করা, গোপন ক্যামেরার সাহায্যে তার আভ্যন্তরীণ অবস্থার ভিডিও ধারণ করা, বিভিন্ন ডিভাইসের সাহায্য কথোপকথন রেকর্ড করা ইত্যাদি সব হারাম।

তবে ইসলাম, দেশ, সমাজ ও মানুষের নিরাপত্তা বিধান, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, চোর-ডাকাত, খুনি, সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও দুর্নীতিবাজ, প্রতারক ইত্যাদি অপরাধী ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে জড়িত লোকদেরকে খুঁজে বের করা, সরকারের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত অযোগ্য ও ফাঁকিবাজ লোকদেরকে চিহ্নিত করা, যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা,তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তাদেরকে নানাভাবে নজরদারিতে রাখা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে সরকারি গোয়েন্দা বিভাগে (National Security Intelligence) কাজ করা এর আওতাভুক্ত নয়। কেননা এগুলো রাষ্ট্রের উপর অপরিহার্য দায়িত্ব।

বরং এ বিভাগে কাজ করার পেছনে ইসলাম, দেশ ও মানুষের কল্যাণ সাধন করার নিয়ত থাকলে এর বিনিময়ে আল্লাহর নিকট সওয়াবও অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। কেননা মহান আল্লাহ নিয়ত অনুযায়ী বান্দাকে সওয়াব দান করে থাকেন। “ইন্নামাল আ’মালু বিন নিয়্যাত।” [সহিহ বুখারি]

তবে এ কথায় কোনও সন্দেহ নাই যে, এ বিভাগে কাজ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা কেউ যদি এই সুযোগে মানুষের ব্যক্তিগত পাপাচার ও গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করে বা কাউকে বিপদে ফেলা বা কারও ক্ষতি করার নিয়তে এ কাজ করে তাহলে নি:সন্দেহে গুনাহগার হবে এবং আখিরাতে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হবে।

সুতরাং সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য আল্লাহকে ভয় করা কর্তব্য যেন, কোনোভাবে এ দায়িত্বের অপব্যবহার করা না নয়।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬◯◍◯▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Share: