আসমানি কিতাব সমূহের প্রতি বিশ্বাস এবং সেগুলোর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি নিরসন

আসমানি কিতাব সমূহের প্রতি বিশ্বাস এবং সেগুলোর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি নিরসন
(আসমানি কিতাব ১০৪ খানা-এ তথ্য কি সঠিক?)
▬▬▬◄❖►▬▬▬
প্রশ্ন: আমরা ছোটকাল থেকে শুনে এসেছি যে, আসমানী কিতাবের সংখ্য একশ চার খানা। সেগুলো মধ্যে প্রসিদ্ধ চার খানা। সহিহ হাদিসের আলোকে এ কথা কি প্রমাণিত? আশা করি ‘আসমানী কিতাব সমূহের উপর বিশ্বাস’ সংক্রান্ত বিষয়ে সঠিক তথ্য দিয়ে উপকৃত করবেন।

উত্তর:

আল্লাহ তাআলা মানবজাতির পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে যুগে যুগে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে অনেক আসমানি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য সামগ্রিকভাবে এ সকল আসমানি কিতাবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য- চাই সেগুলোর নাম ও সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাক অথবা না যাক।

এ বিশ্বাস ঈমানের ছয় টি স্তম্ভ (আরকানুল ঈমান) এর অন্যতম। এ ছাড়া কোনক্রমেই ঈমানের দাবী পূর্ণাঙ্গতা পাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ
“আর বলো, আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি।” (সূরা শুরা: ১৫)
এখন প্রশ্ন হল, এগুলোর সংখ্যা কয়টি?
উত্তর: কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত যে, মৌলিক আসমানি কিতাবের সংখ্যা চারটি। এগুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের রোকন (স্তম্ভ)। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।

সে চারটি কিতাব হল (নাজিলের ক্রম অনুযায়ী):

❖ ১) তাওরাত (মূসা আলাইহিস সালাম এর উপর অবতীর্ণ)
وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ لَعَلَّهُمْ يَهْتَدُونَ
“আমি মুসাকে কিতাব (তাওরাত) দিয়েছিলাম যাতে তারা সৎপথ পায়।” (সূরা মুমিনূন: ৪৮)
❖ ২) যাবুর (দাউদ আলাইহিস সালাম এর উপর অবতীর্ণ)।
আল্লাহ তাআলা বলেন: وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا
“আর আমি দাউদকে দিয়েছি যাবুর।” (সূরা ইসরা: ৫৫)
❖ ৩) ইঞ্জিল (ঈসা আলাইহিস সালাম এর উপর অবতীর্ণ)
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَقَفَّيْنَا عَلَىٰ آثَارِهِم بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ ۖ وَآتَيْنَاهُ الْإِنجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِينَ
“আমি তাদের পেছনে ঈসা ইবনে মরিয়মকে প্রেরণ করেছি। তিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়ন কারী ছিলেন। আমি তাঁকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়েত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়ন করে পথ প্রদর্শন করে এবং এটি আল্লাহ ভীরুদের জন্যে হেদায়েত উপদেশ বানী।” (সূরা মায়িদা: ৪৬)

❖ ৪) আল কুরআন (শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি অবতীর্ণ)।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَأَنزَلَ التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ – مِن قَبْلُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَأَنزَلَ الْفُرْقَانَ ۗ
“তিনি আপনার প্রতি কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন সত্যতার সাথে; যা সত্যায়ন করে পূর্ববর্তী কিতাব সমুহের। নাযিল করেছেন তাওরাত ও ইঞ্জিল, এ কিতাবের পূর্বে, মানুষের হেদায়েতের জন্যে এবং অবতীর্ণ করেছেন ফুরকান [সত্য-মিথ্যা নিরূপণকারী গ্রন্থ আল কুরআন]।” (সূরা আলে ইমরান: ৩ ও ৪)

এ ছাড়াও ইবরাহীম ও মুসা আলাইহিমাস সালাম এর অবতীর্ণ সহিফা (ছোট ছোট পুস্তিকা) সমূহের প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক। এগুলোর সংখ্যা কুরআন-হাদিসে বর্ণিত হয় নি।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ هَـٰذَا لَفِي الصُّحُفِ الْأُولَىٰ -صُحُفِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ
“এটা লিখিত রয়েছে পূর্ববর্তী সহিফা (পুস্তিকা); ইব্রাহীম ও মুসার সহীফা (পুস্তিকা) সমূহে।” (সূরা আ’লা: ১৮ ও ১৯)

উল্লেখ্য যে, সর্বশেষ আসমানী কিতাব আল কুরআনের দেয়া ভাষ্য অনুযায়ী উপরোক্ত আসমানী কিতাব সমূহের মধ্যে একমাত্র কুরআন ছাড়া সবগুলোই বিকৃতির শিকার। ঐ সকল ধর্মের ধর্মীয় নেতারা ইচ্ছামত তাদের কিতাবে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেছে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তাওরাত ও ইন্জিলের সমন্বিত গ্রন্থ বাইবেল-যার পূর্বযুগ ও আধুনিক যুগের ভার্সনে অনেক বৈপরিত্য ও পরির্তন দেখা যায়। একমাত্র কুরআনই অবিকৃত ও অপরবর্তিত আসমানী গ্রন্থ যা আজ পর্যন্ত দুনিয়ার বুকে বিদ্যমান রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে ইনশাআল্লাহ।

🌀 ‘আসমানি গ্রন্থ ১০৪ খানা’ এ মর্মে বর্ণিত হাদিসটি বানোয়াট মতান্তরে অত্যন্ত দুর্বল:

‘আসমানি গ্রন্থ ১০৪ খানা’ এ মর্মে একটি কথা আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। আমাদের দেশে ইসলাম শিক্ষার বইয়েও এ তথ্য লেখা আছে। কিন্তু মুলত: এ তথ্যটি একটি বানোয়াট (কারো কারো মতে অত্যন্ত দুর্বল) হাদিসের উপর প্রতিষ্ঠিত।

এ মর্মে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে ইবনে হিব্বান, ইবনে মারদাওয়াইহ, আবদ বিন হুমাইদ এবং ইবনে আসাকির, তাফসীরে কুরতুবী এবং সুয়ূতীর দুররে মানসূর ইত্যাদি বিভিন্ন কিতাবে। কিন্তু গবেষক হাদিস বিশারদগণের মতে
এটি বাতিল/বানোয়াট।
হাদিসটি হল:
عن أبي ذر الغفاري رضي الله عنه أنه سأل النبي صلى الله عليه وسلم كم كتاباً أنزل الله؟ قال: مائة كتاب، وأربعة كتب، أنزل على شيث خمسون صحيفة، وأنزل على أخنوخ (إدريس) ثلاثون صحيفة، وأنزل على إبراهيم عشر صحائف، وأنزل على موسى قبل التوراة عشر صحائف، وأنزل التوراة والإنجيل والزبور والفرقان

আবু যর রা. হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন:
আল্লাহ তাআলা কতটি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন?
তিনি বললেন: ১০৪টি।

সীস আ. এর উপর অবতীর্ণ করেছেন ৫০টি সহীফা।
উখনূখ (ইদরীস আ.) এর উপর ৩০টি সহীফা।
ইবরাহীম আ. এর উপর ১০টি সহীফা।
আর তাওরাত নাজিলের পূর্বে মূসা আ. এর উপর ১০টি সহীফা।
আরও অবতীর্ণ করেছেন তাওরাত, ইনজিল, যাবুর এবং ফুরকান (কুরআন)।
(লম্বা হাদিসের অংশ)

এ হাদিসটি বাতিল/বানোয়াট।

হায়সামী তার মাওয়ারিদুয যামআন موارد الظمآن গ্রন্থে বলেন:
এ হাদিসের সনদে ইবরাহীম বিন হাশিম বিন ইয়াহিয়া আল গাসসানী নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। তার ব্যাপারে আবু হাতিম প্রমুখ বলেন: كذاب (মিথ্যুক)।
এ হাদিসটির ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের মতামত বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এই লিংকে:
https://cutt.ly/cwlxTQg

মহান আল্লাহ আমাদেরকে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নাজিলকৃত কিতাবের উপর যথাযথ বিশ্বাস স্থাপন করে সে আলোকে আমাদের জীবন পরিচালনা করার তওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহু আলাম
▬▬▬◄❖►▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
জুবাইল, সৌদি আরব।।