প্রশ্ন: নবজাতক কন্যা সন্তানের সপ্তম দিনে দিনে মাথার চুল মুণ্ডন করা জায়েয আছে কি? না কি এ বিধান কেবল ছেলে সন্তানের জন্য? এবং জন্মের সপ্তম দিনে মেয়ে সন্তানের মাথার চুল মুণ্ডন করার পর আর কখনো তা মুণ্ডন করা জায়েয নয়-এ কথা কি সঠিক?
উত্তর:
সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে পিতামাতার জন্য তার আকিকা দেয়া সুন্নত মুআক্কাদা। কেননা, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«كُلُّ غُلاَمٍ رَهِينَةٌ بِعَقِيقَتِهِ تُذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ سَابِعِهِ وَيُحْلَقُ وَيُسَمَّى»
‘প্রত্যেক শিশুই তার আকিকার সাথে আবদ্ধ থাকে। জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে (আকিকার পশু) জবাই করা হবে এবং তার মাথার চুল মুণ্ডন করা হবে আর নাম রাখা হবে। [আবু দাউদ : ২৮৪০, মুসনাদ আহমদ : ২০০৯৫।]
এখন প্রশ্ন হল, মাথার মাথার চুল মুণ্ডন করা ছেলে শিশু এবং মেয়ে শিশু উভয়ের জন্যই কি সুন্নত না কি কেবল ছেলে শিশুর জন্য?
এ বিষয় সম্মানিত ইমামদের মাঝে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। যেমন:
🌀 ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম মালিক সহ একদল আলেম বলেন, এ হাদিসটি সকল নবজাতক শিশুকে শামিল করবে সে ছেলে হোক অথবা মেয়ে হোক। অর্থাৎ পুত্র ও কন্যা উভয়ের জন্যই সপ্তম দিনে আকিকা করা এবং মাথার চুল মুণ্ডন করা সুন্নত। কেননা, আরবি ভাষায় যখন কেবল পুরুষ লিঙ্গ ব্যবহৃত হয় তখন তা দ্বারা পুরুষ ও মহিলা উভয় উদ্দেশ্য হয়। স্ত্রী লিঙ্গকে পৃথক করতে হলে আলাদা দলীল প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখানে এমন কোন দলীল নাই। সুতরাং পুত্র ও কন্যা উভয়ের উপর একই বিধান প্রযোজ্য হবে।
এ ছাড়াও তারা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা তাদের মতের পক্ষে দলীল দেন। হাদিসটি হল, ইমাম মালিক বর্ণনা করেন, জাফর বিন মুহাম্মদ থেকে- জাফর বর্ণনা করেন তার পিতা মুহাম্মদ থেকে। তিনি বলেন,
وَزَنَتْ فاطمة بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم شعر حسن وحسين وزينب وأم كلثوم ، فَتَصَدّقَتْ بِزِنَةِ ذلك فضة
“ফাতিমা রা. তার তার দুই ছেলে হাসান ও হুসাইন এবং দুই মেয়ে যয়নব ও উম্মে কুলসুম এর (মাথার চুল মুণ্ডন করে) তাদের চুলের ওজন বরাবর রৌপ্য সদকা করেছেন।” (মুয়াত্তা মালিক। তবে মুরসাল হওয়ার কারণে হাদিসটি যঈফ)। এ মর্মে আরেকটি হাদিস আছে কিন্তু সেটাও মুনকাতি বা সনদ (বর্ণনা সূত্র) বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে যঈফ।
🌀 পক্ষান্তরে হাম্বলী মাযহাবের একটি মত হল, এ হাদিসটি কেবল ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য; মেয়েদের জন্য নয়। কেননা হাদীসে সাধারণভাবে মেয়েদের চুল মুণ্ডনে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সুতরাং তা এখানেও তা প্রযোজ্য হবে। এতে মেয়ের সৃষ্টিগত বিকৃতি সাধিত হয়।
তাই এ মতানুসারে মেয়েদের জন্য মাথার চুল মুণ্ডন করা সুন্নত নয় বরং সপ্তম দিনে সাধারণভাবে নবজাতক কন্যা সন্তানকে গোসল দিবে এবং তার শরীরে লেগে থাকা, রক্ত ও ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে কিন্তু মাথার চুল মুণ্ডন করবে না।
(বিন বায, উসাইমীন প্রমুখ আলেমগণ এ পক্ষেই মত দিয়েছেন।)
তবে দুটি মতের মধ্যে জুমহুর বা অধিকাংশ ইমামদের মতই অধিক নির্ভরযোগ্য। অর্থাৎ ৭ম দিনে আকিকার সময় ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই মাথার চুল মুণ্ডন করা সুন্নত ইনশাআল্লাহ। কেননা হাদিসের ভাষা থেকে ছেলে ও মেয়ে উভয়ই প্রমাণিত হয় এবং নবজাতক মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডন করার নিষেধের পক্ষে আলাদা কোন দলীল নাই।
⭕ অবশ্য কোন মহিলা যদি কোন মৃত্যুর প্রতি শোক প্রকাশার্থে মাথার চুল মুণ্ডন করে ফেলে তাহলে সর্বসম্মত ক্রমে তা হারাম। (কিন্তু তা নবজাতকের সাথে কোন সম্পর্ক নাই।) হাদিসটি হল:
আবু বুরদাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: (তাঁর পিতা) আবু মূসা আশআরী (রাঃ) যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আর (ঐ সময়) তাঁর মাথা তাঁর এক স্ত্রীর কোলে রাখা ছিল এবং সে চিৎকার ক’রে কান্না করতে লাগল। তিনি (অজ্ঞান থাকার কারণে) তাকে বাধা দিতে পারলেন না। সুতরাং যখন তিনি চেতনা ফিরে পেলেন, তখন বলে উঠলেন,
أَنَا بَرِيءٌ مِمَّنْ بَرِىءَ مِنْهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم بَرِيءٌ مِنَ الصَّالِقَةِ وَالحَالِقَةِ وَالشَّاقَّةِ
“আমি সেই মহিলা থেকে সম্পর্ক মুক্ত, যে মহিলা থেকে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কমুক্ত হয়েছেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেই মহিলা থেকে সম্পর্কমুক্ত হয়েছেন, যে শোকে উচ্চ স্বরে মাতম ক’রে কান্না করে, মাথা মুণ্ডন করে এবং কাপড় ছিঁড়ে ফেলে।” (বুখারী ১২৯৬, মুসলিম ২৯৮)
🔰 আকিকার সময় ছাড়া অন্য সময় ছোট মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডন করার হুকুম:
আকিকা ব্যতিরেকে অন্য সময় একান্ত দরকার ছাড়া মেয়েদের চুল মুণ্ডন করা ঠিক নয়। তবে যদি রোগের চিকিৎসার জন্য মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রয়োজন হয় অথবা যদি প্রমাণিত হয় যে, চুল মুণ্ডন করলে মাথায় ভালোভাবে চুল গজাবে, চুল ঘন হবে, চুলের গোড়া শক্ত হবে ইত্যাদি তাহলে এ সব কারণে ছোট মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডন করা জায়েয রয়েছে। অন্যথায় মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডানো ঠিক নয়। কারণ, চুল থাকা মেয়েদের একটি সৃষ্টিগত সৌন্দর্য। সুতরাং তা বিকৃত করা যাবে না। তাছাড়া এতে করে ছেলেদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। আর ইসলামে মেয়েদের জন্য ছেলেদের সাদৃশ্য অবলম্বনের ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যেমন ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
لَعَنَ الْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ وَالْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভিশাপ দিয়েছেন যেসব নারী পুরুষের বেশ ধারণ করে এবং যেসব পুরুষ নারীদের বেশ ধারণ করে। [আবু দাউদ, অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছেদ,অনুচ্ছেদ: নারীদের পোশাক। সহীহ]
সুতরাং কোন অভিভাবক যদি একান্ত জরুরি দরকার ছাড়া ছোট মেয়েদের মাথার চুল মুণ্ডন করে তাহলে তারা গুনাহগার হবে। কেউ অজ্ঞতা বশত: এমনটি করে থাকলে তার তওবা করা কর্তব্য।
الله أعلم بالصواب
✒✒✒✒✒✒
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব